পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্ৰজাপতির নির্বন্ধ Gł R\0 অক্ষয়। সে আর তোমার মুখের সামনে বলব না! জাক হবে। তবে ইশারায় বলতে পারি মা কালী দয়া করেছেন বটে! এই বলিয়া পুরবালার চিবুক ধরিয়া মুখটি একটুখানি তুলিয়া সকৌতুকে স্নিগ্ধ প্রেমে একবার নিরীক্ষণ করিয়া দেখিলেন। পুরবালা কৃত্ৰিম কলহে মুখ সরাইয়া লইয়া কহিলেন, “তবে আমিও বলি, বাবা ভোলানাথের নদীভৃঙ্গীর অভাব ছিল না, আমাকে বুঝি তিনি দয়া করেছিলেন!” অক্ষয় । তা হতে পারে, সেইজন্যেই কার্তিকটি পেয়েছা! পুরবালা। আবার ঠাট্টা শুরু হল ? অক্ষয়। কার্তিকের কথাটা বুঝি ঠাট্টা ? গা ছুয়ে বলছি। ওটা আমার অন্তরের বিশ্বাস! এমন সময় শৈলবালার প্রবেশ। ইনি মেজো বোন। বিবাহের এক মাসের মধ্যে বিধবা। চুলগুলি ছোটাে করিয়া ছাটা বলিয়া ছেলের মতো দেখিতে। সংস্কৃত ভাষায় অনার দিয়া বি. এ. পাস করিবার জন্য উৎসুক । শৈল আসিয়া বলিল, “মুখুজ্যোমশায়, এইবার তোমার ছোটাে দুটি শ্যালীকে রক্ষা করো।” অক্ষয়। যদি অরক্ষণীয়া হয়ে থাকেন তো আমি আছি। ব্যাপারটা কী ? 斯 শৈলী। মার কাছে তাড়া খেয়ে রসিকদাদা কোথা থেকে একজোড়া কুলীনের ছেলে এনে হাজির করেছেন, মা স্থির করেছেন তাদের সঙ্গেই তার দুই মেয়ের বিবাহ দেবেন। অক্ষয়। ওরে বাসরে! একেবারে বিয়ের এপিডেমিক ! প্লেগের মতো! এক বাড়িতে একসঙ্গে দুই কন্যাকে আক্রমণ ! ভয় হয় পাছে আমাকেও ধরে। বলিয়া কালাংড়ায় গান ধরিয়া দিলেন বড়ো থাকি কাছাকাছি তাই ভয়ে ভয়ে আছি। নয়ন বচন কোথায় কখন বাজিলে র্বাচি না বাচি । শৈল। এই কি তোমার গান গাবার সময় হল ? অক্ষয়। কী করব ভাই! রোশন চৌকি বাজাতে শিখি নি, তা হলে ধরাতুম। বল কী, শুভকর্ম! দুই শ্যালীর উদবাহবন্ধন ! কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কেন ? শৈলী। বৈশাখ মাসের পর আসছে। বছরে আকাল পড়বে, আর বিয়ের দিন নেই। পুরবালা নিজের স্বামীটি লইয়া সুখী, এবং তাহার বিশ্বাস যেমন করিয়া হােক স্ত্রীলোকের একটা বিবাহ হইয়া গেলেই সুখের দশা। সে মনে মনে খুশি হইয়া বলিল, “তোরা আগে থাকতে ভাবিস কেন শৈল, পাত্ৰ আগে দেখা যাক তো ।” ঢ়িলা লোকেদের স্বভাব এই যে, হঠাৎ একদা অসময়ে তাহারা মন স্থির করে, তখন ভালোমন্দ বিচার করিবার পরিশ্রম স্বীকার না করিয়া একদমে পূর্বকার সুদীর্ঘ শৈথিল্য সারিয়া লইতে চেষ্টা করে। তখন কিছুতেই তাঁহাদের আর এক মুহুর্ত সবুর সয় না। কত্রী ঠাকুরানীর সেইরূপ অবস্থা। তিনি অক্ষয় । কী মা ! জগৎ । তোমার কথা শুনে আর তো মেয়েদের রাখতে পারি। নে ! ইহার মধ্যে এইটুকু আভাস ছিল যে, তাহার মেয়েদের সকল প্রকার দুর্ঘটনার জন্য অক্ষয়ই দায়ী। শৈল কহিল, “ মেয়েদের রাখতে পার না বলেই কি মেয়েদের ফেলে দেবে মা !” জগৎ । ঐ তো ! তোদের কথা শুনলে গায়ে জ্বর আসে। বাবা অক্ষয়, শৈল বিধবা মেয়ে, ওকে এত পড়িয়ে পাস করিয়ে কী হবে বলে দেখি। ওর এত বিদ্যের দরকার কী ? অক্ষয়। মা, শাস্ত্রে লিখেছে, মেয়েমানুষের একটা-না-একটা কিছু উৎপাত থাকা চাই— হয় স্বামী, নয় বিদ্যে, নয়। হিস্টিরিয়া। দেখো না, লক্ষ্মীর আছেন বিষ্ণু, তার আর বিদ্যের দরকার হয় নি, তিনি স্বামীটিকে এবং পেচাটিকে নিয়েই আছেন- আর সরস্বতীর স্বামী নেই, কাজেই তাকে বিদ্যে নিয়ে । থাকতে হয় ।