পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্ৰজাপতির নির্বন্ধ ○ ○> আপনাদের মতো লোকের বিদ্যোবুদ্ধি চাপা থাকে, বাধন কাটলেই একেবারে নাকে মুখে চোখে উছলে উঠবে ।” দিতেই হচ্ছে। বুঝলে ?” অক্ষয় কহিলেন, “সে কিছুই শক্ত নয়। কিন্তু ব্যাপটাইজ আজই তো হবেন ?” রুকেশ্বর ভবিল, ঠাট্টাটা বোঝা যাইতেছে না। হাসিতে হাসিতে জিজ্ঞাসা করিল, “সেটা কিরকম ?” অক্ষয় কিঞ্চিৎ বিস্ময়ের ভাবে কহিলেন, “কেন, কথাই তো আছে, রেভারেন্ড বিশ্বাস আজ রাত্রেই আসছেন। ব্যাপটিজম না হলে তো ক্রিশচীন মতে বিবাহ হতে পারে না!” মৃত্যুঞ্জয় অত্যন্ত ভীত হইয়া কহিল, “ক্রিশচান মতে কী মশায় ?” অক্ষয় কহিলেন, “আপনি যে আকাশ থেকে পড়লেন!! সে হচ্ছে না— ব্যাপটাইজ যেমন করে হােক, আজ রাত্রেই সারতে হচ্ছে। কিছুতেই ছাড়ব না।” মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞাসা করিল, “আপনারা ক্ৰিশ্চন না কি ?” অক্ষয়। মশায়, ন্যাকামি রাখুন। যেন কিছুই জানেন না। মৃত্যুঞ্জয় অত্যন্ত ভীতভাবে কহিল, “মশায়, আমরা হিন্দু, ব্ৰাহ্মণের ছেলে, জাত খোওয়াতে পারব କn'] ||', অক্ষয় হঠাৎ অত্যন্ত উদ্ধতস্বরে কহিলেন, “জাত কিসের মশায়! এ দিকে কলিমন্দির হাতে মুগি খবেন, বিলেত যাবেন, আবার জাত!” মৃত্যুঞ্জয় ব্যস্তসমস্ত হইয়া কহিল, “চুপ, চুপ, চুপ করুন ! কে কোথা থেকে শুনতে পাবে।” তখন দারুকেশ্বর কহিল, “ব্যস্ত হবেন না মশায়, একটু পরামর্শ করে দেখি!” বলিয়া মৃত্যুঞ্জয়কে একটু অন্তরালে ডাকিয়া লইয়া বলিল, “বিলেত থেকে ফিরে সেই তো একবার প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে- তখন ডবল প্ৰায়শ্চিত্ত করে একেবারে ধর্মে ওঠা যাবে। এ সংযোগটা ছাড়লে আর বিলেত যাওয়াটা ঘটে উঠবে না। দেখলি তো কোনো শ্বশুরই রাজি হল না। আর ভাই, ক্ৰিশ্চানের ইকোয় তামাকই যখন খেলুম। তখন ক্ৰিশ্চন হতে আর বাকি কী রইল ?” এই বলিয়া অক্ষয়ের কাছে আসিয়া কহিল, “বিলেত যাওয়াটা তো নিশ্চয় পাকা ? তা হলে ক্রিশচীন হতে মৃত্যুঞ্জয় কহিল, “কিন্তু আজ রাতটা থাক।” দারুকেশ্বর কহিল, “হতে হয় তো চটপট সেরে ফেলে পাড়ি দেওয়াই ভালো— গোড়াতেই বলেছি, শুভস্য শীঘ্ৰং।” ইতিমধ্যে অন্তরালে রমণীগণের সমাগম। দুই থালা ফল মিষ্টান্ন লুচি ও বরফ-জল লইয়া ভূত্যের প্ৰবেশ। ক্ষুন্ন দারুকেশ্বর কহিল, “কই মশায়, অভাগার অদৃষ্টে মুগি বেটা উড়েই গেল নাকি ? কাঁটুলেট কোথায় ?” অক্ষয় মৃদুস্বরে বলিলেন, “আজকের মতো এইটেই চলুক।” দারুকেশ্বর কহিল, “সে কি হয় মশায়! আশা দিয়ে নৈরাশ ! শ্বশুরবাড়ি এসে মাটন চাপ খেতে পাব না ? আর এ যে বরফ-জল মশায়, আমার আবার সন্দির ধাত, সাদা জল সহ্য হয় না।” বলিয়া গান জুড়িয়া দিল, “অভয় দাও তো বলি আমার wish কী” ইত্যাদি। অক্ষয় মৃত্যুঞ্জয়কে কেবলই টিপিতে লাগিলেন এবং অস্পষ্ট স্বরে কহিতে লাগিলেন, “ধরো-না হে, তুমিও ধরে।া-না— চুপচাপ কেন।” সে ব্যক্তি কতক ভয়ে কতক লজ্জায় মৃদু মৃদু যোগ দিতে লাগিল। গানের উচ্ছাস থামিলে অক্ষয় আহারপাত্ৰ দেখাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “নিতান্তই কি এটা চলবে না ?” দারুকেশ্বর ব্যস্ত হইয়া কহিল, “না মশায়, ও—সব রুগীর পথ্যি চলবে না ! মুগি না খেয়েই তো ভারতবর্ষ গেল!” বলিয়া ফাঁড়ফড় করিয়া গুড়গুড়ি টানিতে লাগিল।