পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\Ф o o রবীন্দ্র-রচনাবলী ঠিকই বলেছে ওদের সঙ্গে তার চাল তফাত। আর সকল রকম তফাতের চেয়ে এইটেই দুঃসহ। কী উপায় আছে এর ? এক সময়ে হঠাৎ কী মনে পড়ল, কুমু চলল, নীচের তলায় মোতির মার ঘরের দিকে। সিড়ি দিয়ে নামবার সময় দেখে শু্যামাসুন্দরী উপরে উঠে আসছে। " "কী বউ, চলেছ কোথায় ? আমি যাচ্ছিলুম তোমার ঘরেই।” “কোনো কথা আছে ?” “এমন কিছু নয়। দেখলুম ঠাকুরপোর মেজাজ কিছু চড়া, ভাবলুম তোমাকে একবার জিজ্ঞাসা করে জানি, নতুন প্রণয়ে খটকা বাধল কোনখানটাতে। মনে রেখে বউ, ওর সঙ্গে কী রকম করে বনিয়ে চলতে হয় সে পরামর্শ আমরাই দিতে পারি। বকুলফুলের ঘরে চলেছ বুঝি ? তা যাও, মনটা খোলসা করে এসো গে।” আজ হঠাৎ কুমুর মনে হল খামাসুন্দরী আর মধুসূদন একই মাটিতে গড়া এক কুমোরের চাকে। কেন এ কথা মাথায় এল বলা শক্ত। চরিত্র বিশ্লেষণ করে কিছু বুঝেছে তা নয়, আকারে-প্রকারে বিশেষ যে মিল তাও নয়, তবু দুজনের ভাবগতিকের একটা অনুপ্রাস আছে, যেন খামাসুন্দরীর জগতে আর মধুসূদনের জগতে একই হাওয়া। শু্যামাসুন্দরী যখন বন্ধুত্ব করতে আসে তাও কুমুকে উলটাে দিকে ঠেলা দেয়, গা কেমন করে ওঠে । মোতির মার শোবার ঘরে ঢুকেই কুমু দেখলে নবীনে তাতে মিলে কী একটা নিয়ে হাত-কাড়াকড়ি চলছে। ফিরে যাবে যাবে মনে করছে, এমন সময় নবীন বলে উঠল, “বউদিদি, যেয়ে না যেয়ে না। তোমার কাছেই যাচ্ছিলুম, নালিশ আছে।” “কিসের নালিশ ?” “একটু বোসো, দুঃখের কথা বলি।” তক্তপোশের উপর কুমু বসল। নবীন বললে, “বড়ো অত্যাচার । এই ভদ্রমহিলা আমার বই রেখেছেন লুকিয়ে।” “এমন শাসন কেন ?” “ঈর্ষা— যেহেতু নিজে ইংরেজি পড়তে পারেন না। আমি স্ত্রীশিক্ষার পক্ষে, কিন্তু উনি স্বামী-জাতির এডুকেশনের বিরোধী। আমার বুদ্ধির যতই উন্নতি হচ্ছে, ওঁর বুদ্ধির সঙ্গে ততই গরমিল হওয়াতে ওঁর আক্রোশ। অনেক করে বোঝালেম যে, এতবড়ো যে সীতা তিনিও রামচন্দ্রের পিছনে পিছনেই চলতেন ; বিস্তেবুদ্ধিতে আমি যে তোমার চেয়ে অনেক দূরে এগিয়ে এগিয়ে চলছি এতে বাধা দিয়ে না।”