পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8\')8 রবীন্দ্র-রচনাবলী ‘বোধ হয় কোর্টশিপট পাঠকের বড়ো ভালো লাগিল না। আমি কী করিব । ভালোবাসাবাসির কথা একটাও নাই-- বহুকালসঞ্চিতপ্রণয়ের কথা কিছু নাই— “হে প্রাণ ! হে প্রাণাধিক ! সে-সব কিছুই নাই— ধিক্‌ ! এই গ্রন্থবর্ণিত পাত্ৰগণের চরিত্রের, বিশেষত স্ত্রীচরিত্রের মধ্যে বড়ো-একটা দ্রুততা আছে। তাহারা বড়ো বড়ো সাহসের এবং নৈপুণ্যের কাজ করে অথচ তৎপূর্বে যথেষ্ট ইতস্তত অথবা চিন্তা করে না। সুন্দরী বিদ্যুৎরেখার মতে এক নিমেষে মেঘাবরোধ ছিন্ন করিয়া লক্ষ্যের উপর গিয়৷ পড়ে, কোনো প্রস্তরভিত্তি সেই প্রলয়গতিকে বাধা দিতে পারে না। স্ত্রীলোক যখন কাজ করে তখন এমনি করিয়াই কাজ করে ; তাহার সমগ্র মনপ্রাণ লইয়া বিবেচনা চিন্তা বিসর্জন দিয়া একেবারে অব্যবহিতভাবে উদ্দেশ্বসাধনে প্রবৃত্ত হয়। কিন্তু যে হৃদয়বৃত্তি প্রবল হইয়া তাহার প্রাত্যহিক গৃহকর্মসীমার বাহিরে তাহাকে অনিবার্যবেগে আকর্ষণ করিয়া আনে, পাঠককে পূর্ব হইতে তাহার একটা পরিচয় একটু সংবাদ দেওয়া আবশ্বক। বঙ্কিমবাবু তাহ পুরাপুরি দেন নাই। . ميكي | সেইজন্য ‘রাজসিংহ প্রথম পড়িতে পড়িতে মনে হয় সহসা এই উপন্যাস-জগৎ হইতে মাধ্যাকর্ষণশক্তির প্রভাব যেন অনেকটা হ্রাস হইয়া গিয়াছে। আমাদিগকে যেখানে কষ্টে চলিতে হয় এই উপন্যাসের লোকেরা সেখানে লাফাইয়া চলিতে পারে। সংসারে আমরা চিন্তা শঙ্কা সংশয় -ভারে ভারাক্রান্ত, কার্যক্ষেত্রে সর্বদাই দ্বিধাপরায়ণ মনের বোঝাটা বহিয়া বেড়াইতে হয়— কিন্তু ‘রাজসিংহ-জগতে অধিকাংশ লোকের যেন আপনার ভার নাই । যাহারা আজকালকার ইংরাজি নভেল বেশি পড়ে তাহদের কাছে এই লঘুতা বড়ো বিস্ময়জনক। আধুনিক ইংরাজি নভেলে পদে পদে বিশ্লেষণ— একটা সামান্যতম কার্যের সহিত তাহার দূরতম কারণপরম্পরা গাথিয়া দিয়া সেটাকে বৃহদাকার করিয়া তোলা হয়— ব্যাপারটা হয়তে ছোটো কিন্তু তাহার নথিটা বড়ো বিপর্যয়। আজকালকার নভেলিস্টর কিছুই বাদ দিতে চান না, তাহীদের কাছে সকলই গুরুতর। এইজন্য উপন্যাসে সংসারের ওজন ভয়ংকর বাড়িয়া উঠিয়াছে। ইংরাজের কথা জানি না, কিন্তু আমাদের মতো পাঠককে তাহাতে অত্যন্ত ক্লিষ্ট করে। এইজন্য আধুনিক উপন্যাস আরম্ভ করিতে ভয় হয়। মনে হয়, কর্মক্লাস্ত মানবহৃদয়ের পক্ষে বাস্তবজগতের চিস্তাভার অনেক সময় যথেষ্টের বেশি হইয় পড়ে, আবার যদি সাহিত্যও নির্দয় হয় তবে আর পলায়নের পথ থাকে না। সাহিত্যে আমরা জগতের সত্য চাই, কিন্তু জগতের ভার চাহি না ।