পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

five Oo তখন কলিকাতার স্কুলে পড়তে। তোমার বাপ গ্রামের দলপতি হইয়া বলিলেন- মেয়েকে যদি স্বামীগৃহে পাঠানো অভিপ্ৰায় থাকে। তবে সে মেয়েকে আর ঘরে লাইতে পরিবে না। আমি তঁহকে হাতে পায়ে ধরিয়া বলিলাম, দাদা, এ যাত্রা তুমি আমাকে ক্ষমা করো। আমি ছেলেটিকে গোবর খাওয়াইয়া প্ৰায়শ্চিত্ত করাইতেছি, তোমরা তাহাকে জাতে তুলিয়া লও। তোমার বাপ কিছুতেই রাজি হইলেন না, আমিও আমার একমাত্র মেয়েকে ত্যাগ করিতে পারিলাম না। জাত ছাড়িয়া দেশ ছাড়িয়া কলিকাতায় আসিয়া ঘর করিলাম। এখানে আসিয়াও আপদ মিটাল না। আমার ভ্রাতুষ্পপুত্রের যখন বিবাহের সমস্ত আয়োজন করিয়াছি তোমার বাপ কন্যাকর্তাদের উত্তেজিত করিয়া সে বিবাহ ভাঙিয়া দিলেন। আমি প্রতিজ্ঞা করিলাম যদি ইহার প্রতিশোধনা লই। তবে আমি ব্ৰাহ্মণের ছেলে নহি দু-এইবার কতকটা বুঝিতে পারিয়াছ- কিন্তু আর-একটু সবুর করে- সমস্ত ঘটনাটি শুনিলে খুশি হইবে- ইহার মধ্যে একটু রস আছে। “তুমি যখন কলেজে পড়তে তোমার বাসার পাশেই বিপ্রদাস চাটুজ্যের বাড়ি ছিল। বেচারা এখন মারা গিয়াছে। চাটুজ্যেমহাশয়ের বাড়িতে কুসুম নামে একটি শৈশববিধবা অন্যথা কায়স্থ কন্যা আশ্রিতভাবে থাকিত। মেয়েটি বড়ো সুন্দরী-বুড়ো ব্ৰাহ্মণ কলেজের ছেলেদের দৃষ্টিপথ হইতে তাহাকে সংবরণ করিয়া রাখিবার জন্য কিছু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হইয়া পড়িয়াছিল। কিন্তু বুড়োমানুষকে ফাকি দেওয়া একটি মেয়ের পক্ষে কিছুই শক্ত নহে। মেয়েট প্রায়ই কাপড় শুকাইতে দিতে ছাতে উঠিত এবং তোমারও বােধ করি ছাতে না উঠিলে পড়া মুখস্থ হইত না। পরস্পরের ছাত হইতে তোমাদের কোনোরূপ কথাবার্ত হইত কি না সে তোমরাই জানো, কিন্তু মেয়েটির ভাবগতিক, দেখিয়া বুড়ার মনেও সন্দেহ হইল। কারণ, কাজকর্মে তাহার ক্ৰমিক ভুল হইতে দেখা গেল এবং তপস্বিনী গীেরীর মতো দিন দিন সে আহারনিদ্ৰা ত্যাগ করিতে লাগিল । এক-একদিন সন্ধ্যাবেলায় সে বুড়ার সম্মুখেই অকারণে অশ্রু সংবরণ করিতে পারিত না । “অবশেষে বুড়া আবিষ্কার করিল, ছাতে তোমাদের মধ্যে সময়ে অসময়ে নীরব দেখাসাক্ষাৎ চলিয়া থাকে- এমনকি, কলেজ কামাই করিয়াও মধ্যাহ্নে চিলের ঘরের ছায়ায় ছাতের কোণে তুমি বই হাতে করিয়া বসিয়া থাকিতে ; নির্জন অধ্যয়নে সহসা তোমার এত উৎসাহ জন্মিয়ছিল। বিপ্রদাস যখন আমার কাছে পরামর্শ জানিতে আসিল আমি কহিলাম, খুড়ো, তুমি তো অনেক দিন হইতে কাশী যাইবার মানস করিয়াছ- মেয়েটিকে আমার কাছে রাখিয়া তীৰ্থবাস করিতে যাও, আমি তাহার ভার লইতেছি। “বিপ্রদাস তীর্থে গেল। আমি মেয়েটিকে শ্ৰীপতি চাটুজ্যের বাসায় রাখিয়া তাহাকেই মেয়ের বাপ বলিয়া চালাইলাম। তাহার পর যাহা হইল তোমার জানা আছে। তোমার আছে আগাগোড়া সব কথা খোলসা করিয়া বলিয়া বড়ো আনন্দ লাভ করিলাম। এ যেন একটি গল্পের মতো । ইচ্ছা আছে, সমস্ত লিখিয়া একটি বই করিয়া ছাপাইব । আমার লেখা আসে না। আমার ভাইপোেটা শুনিতেছি একটু-আধটু লেখে- তাহাকে দিয়া লেখাইবার মানস আছে। কিন্তু তোমাতে তাহাতে মিলিয়া লিখিলে সব চেয়ে ভালো হয়, কারণ, গল্পের | উপসংহারটি আমার ভালো করিয়া জানা নাই।” । হেমন্ত পারিশংকরের এই শেষ কথাগুলিতে, বড়ো একটা কান না দিয়া কহিল, “কুসুম এই বিবাহে কোনো আপত্তি করে নাই ?” প্যারিশংকর কহিল, “আপত্তি ছিল কি না বোঝা ভারি শক্ত। জািন তো বাপু, মেয়েমানুষের মন ; যখন 'না' বলে তখন 'হাঁ' বুঝিতে হয়। প্রথমে তাে দিনকতক নূতন বাড়িতে আসিয়া তোমাকে না দেখিতে পাইয়া কেমন পাগলের মতো হইয়া গেল ! তুমিও দেখিলাম কোথা হইতে সন্ধান পাইয়াছ ; প্রায়ই বই হাতে করিয়া কলেজে যাত্রা করিয়া তোমার পথ ভুল হইত— এবং শ্ৰীপতির বাসার সম্মুখে আসিয়া কী যেন খুজিয়া বেড়াইতে- ঠিক যে প্রেসিডেন্সি কলেজের রাস্তা খুঁজতে তাহা বোধ হইত না, কারণ ভদ্রলোকের বাড়ির জানালার ভিতর দিয়া কেবল পতঙ্গ এবং উন্মাদ যুবকদের হৃদয়ের পথ ছিল মাত্র। দেখিয়া শুনিয়া আমার বড়ো দুঃখ হইল। দেখিলাম, তোমার পড়ার বড়োই ব্যাঘাত হইতেছে এবং মেয়েটির অবস্থাও সংকটাপন্ন । "একদিন কুসুমকে ডাকিয়া লইয়া কহিলাম, বাছা, আমি বুড়ামানুষ, আমার কাছে লজা করিবার আবশ্যক নাই-তুমি যাহাকে মনে মনে প্রার্থনা কর আমি জানি। ছেলেটিও মাটি হইবার জোহইয়াছে। আমার ইচ্ছা! তোমাদের মিলন হয়। শুনিবামাত্র কুসুম একেবারে বুক ফাটিয়া কঁদিয়া উঠিল এবং ছুটিয়া পালাইয়া গেল।