পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VVr রবীন্দ্র-রচনাবলী মৎস্যপুচ্ছের তাড়নায় জলের মধ্যে যে গুঢ় আন্দোলন চলিতে থাকে, সরোবরের পদ্ম যেমন তাহার মধ্যে বুঝিতে পারিলেন। আজ শেষ দিন। আজ জয়পরাজয় নির্ণয় হইবে। রাজা তঁহার কবির প্রতি তীব্র দৃষ্টিপাত করিলেন তাহার অর্থ এই, আজ নিরুত্তর হইয়া থাকিলে চলিবে না- তোমার যথাসাধ্য চেষ্টা করিতে হইবে। শেখর শ্রান্তভাবে উঠিয়া দাড়াইলেন, কেবল এই কটি কথা বলিলেন, “বীণাপাণি শ্বেতভুজা, তুমি যদি তোমার কমলবন শূন্য করিয়া আজ মল্লভূমিতে আসিয়া দাড়াইলে তবে তোমার চরণাসক্ত যে ভক্তগণ অমৃতপিপাসী, তাহাদের কী গতি হইবে।” মুখ ঈষৎ উপরে তুলিয়া করুশ স্বরে বলিলেন, যেন শ্বেতভুজ বীণাপাণি নতনয়নে রাজান্তঃপুরে বাতায়নসম্মুখে দাড়াইয়া আছেন। তখন পুণ্ডৱীক সশব্দে হাস্য করিলেন, এবং শেখর শব্দের শেষ দুই অক্ষর গ্রহণ করিয়া অনর্গল শ্লোব রচনা করিয়া গেলেন। বলিলেন, “পদ্মবনের সহিত খরের কী সম্পর্ক। এবং সংগীতের বিস্তর চর্চাসত্ত্বেও উক্ত প্ৰাণী কিরূপ ফললাভ করিয়াছে। আর সরস্বতীর অধিষ্ঠান তো পুণ্ডরীকেই, মহারাজের অধিকারে তিনি কী অপরাধ করিয়াছিলেন যে এদেশে তঁহাকে খর-বাহন করিয়া অপমান করা হইতেছে।” পণ্ডিতেরা এই প্রত্যুত্তরে উচ্চস্বরে হাসিতে লাগিলেন। সভাসদেরাও তাঁহাতে যোগ দিল— তাহদের দেখাদেখি সভাসুদ্ধ সমস্ত লােক, যাহারা বুঝিল এবং না-বুঝিল, সকলেই হাসিতে লাগিল। ইহার উপযুক্ত প্রত্যুত্তরের প্রত্যাশায় রাজা তাহার কবিসখাকে বার বার অন্ধুশের ন্যায় তীক্ষ দৃষ্টির দ্বার তাড়না করিতে লাগিলেন। কিন্তু শেখর তাহার প্রতি কিছুমাত্র মনোযোগ না করিয়া অটলভাবে বসিয়া রহিলেন । ቆr তখন রাজা শেখরের প্রতি মনে মনে অত্যন্ত রুষ্ট হইয়া সিংহাসন হইতে নামিয়া আসিলেন এবং নিজের কণ্ঠ হইতে মুক্তার মালা খুলিয়া পুণ্ডরীকের গলায় পরাইয়া দিলেন- সভান্থ সকলেই ধন্য ধন্য করিতে লাগিল। অন্তঃপুর হইতে এককালে অনেকগুলি বলয় কঙ্কণ নূপুরের শব্দ শুনা গেল— তাহাই শুনিয়া শেখর আসন ছাড়িয়া উঠিলেন এবং ধীরে ধীরে সভাগৃহ হইতে বাহির হইয়া গেলেন। Gł কৃষ্ণচতুর্দশীর রাত্রি। ঘন অন্ধকার । ফুলের গন্ধ বহিয়া দক্ষিণের বাতাস উদার বিশ্ববন্ধুর ন্যায় মুক্ত বাতায়ন দিয়া নগরের ঘরে ঘরে প্রবেশ করিতেছে। ঘরের কাষ্ঠমঞ্চ হইতে শেখর আপনার পুঁথিগুলি পাড়িয়া সম্মুখে স্তৃপাকার করিয়া রাখিয়াছেন। তাহার মধ্য হইতে বাছিয়া বাছিয়া নিজের রচিত গ্রন্থগুলি পৃথক করিয়া রাখিলেন। অনেকদিনকার অনেক লেখা। তাহার মধ্যে অনেকগুলি রচনা তিনি নিজেই প্রয় ভুলিয়া গিয়াছিলেন। সেগুলি উলটাইয়া পালটাইয়া এখানে ওখানে পড়িয়া দেখিতে লাগিলেন। আজ তাহার কাছে ইহা সমস্তই অকিঞ্চিৎকর বলিয়া বোধ क्षेळ | নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, “সমস্ত জীবনের এই কি সঞ্চয়! কতকগুলা কথা এবং ছন্দ এবং মিল!’ ইহার মধ্যে যে কোনো সৌন্দর্য, মানবের কোনো চির-আনন্দ, কোনো বিশ্বসংগীতের প্রতিধ্বনি, তঁহার হৃদয়ের কোনাে গভীর আত্মপ্রকাশ নিবদ্ধ হইয়া আছে- আজ তিনি তাহা দেখিতে পাইলেন না। রোগীর মুখে যেমন কোনো খাদ্যই রুচে না, তেমনি আজ তাহার হাতের কাছে যাহা কিছু আসিল সমস্তই ঠেলিয়া ঠেলিয়া সমস্তই শূন্য বিড়ম্বনা বলিয়া ঠেকিতে লাগিল। : তখন একটি একটি করিয়া তঁহার পুঁথি ছিড়িয়া সম্মুখের জ্বলন্ত অগ্নিভাণ্ডে নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। হঠাৎ একটা উপহাসের কথা মনে উদয় হইল! হাসিতে হাসিতে বলিলেন, "বড়ো বড়ো রাজারা অশ্বমেধযজ্ঞ করিয়া থাকেন- আজ আমার এ কাব্যমেধযজ্ঞ ।' কিন্তু তখনই মনে উদয় হইল, তুলনাটা ঠিক হয় নাই।