পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

'stres ○8Q ছুটি বালকদিগের সর্দার ফটিক চক্রবর্তীর মাথায় চট করিয়া একটা নূতন ভাবোদয় হইল, নদীর ধারে একটা প্ৰকাণ্ড শালাকাষ্ঠ মাস্তুলে রূপান্তরিত হইবার প্রতীক্ষায় পড়িয়া ছিল ; স্থির হইল, সেটা সকলে মিলিয়া গড়াইয়া লইয়া যাইবে । যে-ব্যক্তির কাঠ আবশ্যককালে তাহার যে কতখানি বিস্ময় বিরক্তি এবং অসুবিধা বােধ হইবে, তাহাই উপলব্ধি করিয়া বালকেরা এ প্রস্তাবে সম্পূর্ণ অনুমােদন করিল। কোমর বাধিয়া সকলেই যখন মনোযোগের সহিত কার্যে প্রবৃত্ত হইবার উপক্ৰম করিতেছে, এমন সময়ে ফটিকের কনিষ্ঠ মাখনলাল গভীরভাবে সেই গুড়ির উপরে গিয়া বসিল ; ছেলেরা তাহার এইরূপ উদার ঔদাসীন্য দেখিয়া কিছু বিমর্ষ হইয়া গেল। একজন আসিয়া ভয়ে ভয়ে তাহাকে একটু-আধটু ঠেলিল কিন্তু সে তাঁহাতে কিছুমাত্র বিচলিত হইল না ; এই অকাল-তত্ত্বজ্ঞানী মানব সকলপ্রকার ক্রীড়ার অসারতা সম্বন্ধে নীরবে চিন্তা করিতে লাগিল । ফটিক আসিয়া আস্ফালন করিয়া কহিল, “দেখ, মাের খাবি! এইবেল ওঠ ।” সে তাহাতে আরো একটু নড়িয়াচড়িয়া আসনটি বেশ স্থায়ীরূপে দখল করিয়া লইল । এরূপ স্থলে সাধারণের নিকট রাজসম্মান রক্ষা করিতে হইলে অবাধ্য ভ্রাতার গণ্ডদেশে অনতিবিলম্বে এক চড় কষাইয়া দেওয়া ফটিকের কর্তব্য ছিল- সাহসী হইল না। কিন্তু এমন একটা ভােব ধারণ করিল, যেন ইচ্ছা করিলেই এখনই উহাকে রীতিমত শাসন করিয়া দিতে পারে। কিন্তু করিল না, কারণ পূর্বাপেক্ষা আর-একটা ভালো খেলা মাথায় উদয় হইয়াছে, তাহাতে আর-একটু বেশি মজা আছে। প্রস্তাব করিল, মাখনকে সুদ্ধ ঐ কাঠ গড়াইতে আরম্ভ করা যাক। মাখন মনে করিল, ইহাতে তাহার গীেরব আছে; কিন্তু অন্যান্য পার্থিব গীেরবের ন্যায় ইহার আনুষঙ্গিক যে বিপদের সম্ভাবনাও আছে, তাহা তাহার কিংবা আর-কাহারও মনে উদয় হয় নাই। ছেলেরা কোমর বাধিয়া ঠেলিতে আরম্ভ করিল— ‘মারো ঠেলা হেঁইয়ো, সাবাস জোয়ান হেঁইয়ো।” গুড়ি একপাক ঘুরিতে-না-ঘুরিতেই মাখন তাহার গান্তীর্য গীেরব এবং তত্ত্বজ্ঞান সমেত ভূমিসাৎ হইয়া গেল। খেলার আরম্ভেই এইরূপ আশাতীত ফললাভ করিয়া অন্যান্য বালকেরা বিশেষ হৃষ্ট হইয়া উঠিল, কিন্তু ফটিক কিছু শশব্যস্ত হইল। মাখন তৎক্ষণাৎ ভূমিশয্যা ছাড়িয়া ফটিকের উপরে গিয়া পড়িল, একেবারে অন্ধভাবে মারিতে লাগিল। তাহার নাকে মুখে আঁচড় কাটিয়া কঁদিতে কঁদিতে গৃহাভিমুখে গমন করিল খেলা ভাঙিয়া গেল । - ফটিক গােটাকতক কাশ উৎপাটন করিয়া লইয়া একটা অর্ধনিমগ্ন নীেকার গলুইয়ের উপরে চড়িয়া বসিয়া চুপচাপ করিয়া কাশের গোড়া চিবাইতে লাগিল। এমন সময় একটা বিদেশী নীেক ঘাটে আসিয়া লাগিল । একটি অর্ধবয়সী ভদ্রলোক কঁচা গোফ এবং পাকা চুল লইয়া বাহির হইয়া আসিলেন। বালককে জিজ্ঞাসা করিলেন, “চক্রবর্তদের বাড়ি কোথায়।” বালক ডাটা চিবাইতে চিবাইতে কহিল, “ঐ হােখা।” কিন্তু কোনদিকে যে নির্দেশ করিল কাহারও বুঝিবার সাধ্য রহিল না। ভদ্রলোকটি আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথা ।” । সে বলিল, “জানি নে ৷” বলিয়া পূর্ববৎ তৃণমূল হইতে রসগ্রহণে প্ৰবৃত্ত হইল। বাবুটি তখন অন্য লোকের সাহায্য অবলম্বন করিয়া চক্রবর্তদের গৃহের সন্ধানে চলিলেন। অবিলম্বে বাঘা বাগদি আসিয়া কহিল, “ফটিকদাদা, মা ডাকছে।” ফটিক কহিল, “যাব না।” । সমস্তকে বলপূৰ্ণ আস্ককেল ফরিয়াণ্ডুলিয়াইয়ালে ফলি মিল আকাশেহত গাড়িতে k ফটিককে দেখিবামাত্র তাহার মা অগ্নিমূর্তি হইয়া কহিলেন, “আবার তুই মাখনকে মেরেছিস ।”