পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(SO 跟 , i. রবীন্দ্র-রচনাবলী ..) বড়ো হইয়া উঠিয়া মানুষকে খাটাে করিয়া দেয়। সেটা একটা বিপরীত ব্যাপার। মানুষের আত্মা মানুষের কাজের চেয়ে বড়ো ।। ২ এমন সময় শীর যখন বাকিয়া বসিল, বলিল, আমি কোনোমতেই কাজ করিব না। তখন দায়িত্বের বঁাধন কাটিয়া গেল। তখন টানাটানিতে চিল পড়তেই কাজের নিবিড়তা আলগা হইয়া আসিল— মনের চারি দিকের আকাশে আলো এবং হাওয়া বহিতে লাগিল। তখন দেখা গেল। আমি কাজের মানুষ এ কথাটা যত সত্য, তাহার চেয়ে ঢের বড়ো সত্য আমি মানুষ। সেই বড়ো সত্যটির কাছেই জগৎ সম্পূর্ণ হইয়া দেখা দেয়- বিশ্ববীণা সুন্দর হইয়া বাজে- সমস্ত রূপরসগন্ধ আমার কাছে স্বীকার করে যে “তোমারই মন পাইবার জন্য আমরা বিশ্বের প্রাঙ্গণে মুখ তুলিয়া দাড়াইয়া আছি।” আমার কর্মক্ষেত্রেকে আমি ক্ষুদ্র বলিয়া নিন্দা করিতে চাই না। কিন্তু আমার রোগশয্যা আজ দিগন্তপ্রসারিত আকাশের নীলিমাকে অধিকার করিয়া বিস্তীর্ণ হইয়াছে। আজ আমি আপিসের টোকিতে আসীন নাই, আমি বিরাটের ক্ৰোড়ে শয়ন। সেইখানেই সেই অপরিসীম অবকাশের মাঝখানে আজ আমার নববর্ষের অভ্যুদয় হইল- মৃত্যুর পরিপূর্ণতা যে কী সুগভীর আমি যেন আজ তাহার আস্বাদন পাইলাম। আজ নববর্ষ অতলস্পর্শ মৃত্যুর সুনীল শীতল সুবিপুল অবকাশপূর্ণ স্তব্ধতার মাঝখানে জীবনের পদ্মটিকে যেন বিকশিত করিয়া ধরিয়া দেখাইল । তাই তো আজ বসন্তশেষের সমস্ত ফুলগন্ধ একেবারে আমার মনের উপরে আসিয়া এমন করিয়া ছড়াইয়া পড়িতেছে। তাই তো আমার খোলা জানালা পার হইয়া বিশ্ব আকাশের অতিথিরা এমন অসংকোচে আমার ঘরের মধ্যে আসিয়া প্রবেশ করিতেছে। আলো যে ঐ অন্তরীক্ষে কী সুন্দর করিয়া দাড়াইয়াছে, আর পৃথিবী ঐ তার পায়ের নীচে আঁচল বিছাইয়া কী নিবিড় হর্ষে পুলকিত হইয়া পড়িয়া আছে তাহা যেন এত কাল দেখি নাই। এই আজ আমি যাহা দেখিতেছি এ যে মৃত্যুর পটে আঁকা জীবনের ছবি ; যেখানে বৃহৎ, যেখানে বিরাম, যেখানে নিস্তব্ধ পূর্ণতা, তাহারই উপরে দেখিতেছি। এই সুন্দরী চঞ্চলতার অবিরাম নূপুরনিক্কণ, তাহার নানা রঙের আঁচলখনির এই উচ্ছসিত ঘূৰ্ণগতি । আমি দেখিতেছি বাহিরের দরজায় লক্ষ লক্ষ চন্দ্ৰসূৰ্য গ্ৰহতারা আলো হাতে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, আমি দেখিতেছি মানুষের ইতিহাসে জন্ম-মৃত্যু উত্থান-পতন ঘাত-প্রতিঘাত উচ্চকলরবে উতলা হইয়া ফিরিতেছে- কিন্তু সেও তো ঐ বাহিরের প্রাঙ্গণে । আমি দেখিতেছি। ঐ যে রাজার বাড়ি তাহাতে মহলের পর মহল উঠিয়াছে, তাহার চুড়ার উপরে নিশান মেঘ ভেদ করিয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে সে আর চােখে দেখা যায় না। কিন্তু চাবি যখন লাগিল, দ্বার যখন খুলিল- ভিতর বাড়িতে একি দেখা যায় ! সেখানে আলোয় তো চোখ ঠিকারিয়া পড়ে না, সেখানে সৈন্যসামন্তে ঘর জুড়িয়া তো দাঁড়ায় নাই! সেখানে মণি নাই মানিক নাই, সেখানে চন্দ্ৰতাপে তো মুক্তার ঝালর বুলিতেছে না। সেখানে ছেলেরা ধুলাবালি ছড়াইয়া নিৰ্ভয়ে খেলা করিতেছে, তাহাতে দাগ পড়িবে এমন রাজ-আস্তরণ তো কোথাও বিছানো নাই। সেখানে যুবকযুবতীরা মালা বদল করিবে বলিয়া আঁচল ভরিয়া ফুল তুলিয়াছে কিন্তু রাজোদানের মালী আসিয়া তো কিছুমাত্ৰ হাঁকড়াক করিতেছে না। বৃদ্ধ সেখানে কর্মশালার বহু কলিম চিহ্নিত অনেকদিনের জীর্ণকাপড়খানা ছাড়িয়া ফেলিয়া পট্টবসন পরিতেছে, কোথাও তো কোনো নিষেধ দেখি না। ইহাই আশ্চর্য যে এত ঐশ্বর্য এত প্ৰতাপের মাঝখানটিতে সমস্ত এমন সহজ, এমন আপন! ইহাই আশ্চৰ্য, পা তুলিতে ভয় হয় না, হাত তুলিতে হাত কঁপে না। ইহাই আশ্চর্য যে এমন অভেদ্য রহস্যময় জ্যোতির্ময় লোকলোকান্তরের মাঝখানে এই অতি ক্ষুদ্র মানুষের জন্মমৃত্যু সুখদুঃখ খেলাধূলা কিছুমাত্র ছােটাে নয়, সামান্য নয়, অসংগত নয়সেজন্য কেহ তাহাকে একটুও লজ্জা দিতেছে না। সবাই বলিতেছে তোমার ঐটুকু খেলা, ঐটুকু হাসিকান্নার জন্যই এত আয়োজন— ইহার যতটুকুই তুমি গ্ৰহণ করিতে পার ততটুকুই সে তোমারই- যতদূর পর্যন্ত তুমি দেখিতেছ। সে তোমারই দুই চক্ষুর ধন- যতদূর পর্যন্ত তোমার মন দিয়া বেড়িয়া লইতে পার সে তোমারই মনের সম্পত্তি। তাই এত বড়ো জগৎব্ৰহ্মাণ্ডের মাঝখানে আমার গীেরব ঘুচিল না- ইহার অন্তবিহীন ভারে আমার মাথা এতটুকুও নত হইল না। · কিন্তু ইহাও বাহিরে। আরো ভিতরে যাও- সেখানেই সকলের চেয়ে আশ্চৰ্য। সেইখানেই ধরা পড়ে,