পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ዒOO রবীন্দ্র-রচনাবলী সাজাইয়া মাঘোৎসবের অনুকরণে আমরা খেলা করিতাম। সে খেলায় অনুকরণের আর-আর সমস্ত অঙ্গ একেবারেই অর্থহীন ছিল। কিন্তু গানটা ফাকি ছিল না । এই খেলায় ফুল দিয়া সাজানো একটা টেবিলের উপরে বসিয়া আমি উচ্চকণ্ঠে “দেখিলে তোমার সেই অতুল প্ৰেম-আননে ২* গান গাহিতেছি, বেশ মনে পড়ে । “চিরকালই গানের সুর আমার মনে একটা অনির্বচনীয় আবেগ উপস্থিত করে । এখনো কাজকর্মের মাঝখানে হঠাৎ একটা গান শুনিলে আমার কাছে এক মুহুর্তেই সমস্ত সংসারের ভাবাস্তর হইয়া যায় । এই সমস্ত চোখে-দেখার রাজ্য গানে-শোনার মধ্য দিয়া হঠাৎ একটা কী নূতন অর্থ লাভ করে । হঠাৎ মনে হয়, আমরা যে জগতে আছি বিশেষ করিয়া কেবল তাহার একটা তলার সঙ্গেই সম্পর্ক রাখিয়াছি- এই আলোকের তলা, বস্তুর তলা, কিন্তু এইটেই সমস্তটা নয় । যখন এই বিপুল রহস্যময় প্রাসাদে সুর আর-একটা মহলের একটা জালনা ক্ষণিকের জন্য খুলিয়া দেয়। তখন আমরা কী দেখিতে পাই ! সেখানকার কোনো অভিজ্ঞতা আমাদের নাই, সেইজন্য ভাষায় বলিতে পারি না কী পাইলাম।— কিন্তু বুঝিতে পারি সেদিকেও অপরিসীম সত্য পদার্থ আছে । বিশ্বের সমস্ত স্পন্দিত জাগ্ৰত শক্তি আজ প্ৰধানত বস্তু ও আলোক। -রূপেই প্রতিভাত হইতেছে বলিয়া আজ আমরা এই সূর্যের আলোকে বস্তুর অক্ষর দিয়াই বিশ্বকে অহরহ পাঠ করিতেছি, আর কোনো অবস্থা কল্পনা করিতে পারি না- কিন্তু এই অসীম স্পন্দন যদি আমাদের কাছে আর-কিছু না হইয়া কেবল গগনাব্যাপী অতি বিচিত্র সংগীতরূপেই প্ৰকাশ পাইত। তবে, অক্ষররাপে নহে, বাণীরূপেই আমরা সমস্ত পাইতাম । গানের সুরে যখন অন্তঃকরণের সমস্ত তন্ত্রী কঁপিয়া উঠে তখন অনেক সময় আমার কাছে এই দৃশ্যমান জগৎ যেন আকার-আয়তন-ইন বাণীর ভাবে আপনাকে ব্যক্ত করিতে চেষ্টা করে- তখন যেন বুঝিতে পারি জগৎটাকে যে-ভাবে জানিতেছি তাহা ছাড়া কত রকম ভাবেই যে তাহাকে জানা যাইতে পারিত তাহা আমরা কিছুই জানি না । ‘সেই সময় জ্যোতিদাদার পিয়ানো যন্ত্রের উত্তেজনায়, কতক-বা তাহার রচিত সুরে কতক-বা হিন্দুস্থানি গানের সুরে বাল্মীকিপ্রতিভা গীতিনাট্য রচনা করিয়াছিলাম। তখন বিহারীলাল চক্রবর্তীর সারদামঙ্গল সংগীত আৰ্যদর্শনে বাহির হইতেছিল এবং আমরা তাহাই লইয়া মাতিয়াছিলাম । এই সারদামঙ্গলের আরম্ভ-সগ হইতেই বাল্মীকিপ্রতিভার ভাবটা আমার মাথায় আসে এবং সারদামঙ্গলের দুই-একটি কবিতাও রূপান্তরিত অবস্থায় বাল্মীকিপ্রতিভায় গানরূপে স্থান পাইয়াছে। ‘তেতালার ছাদের উপর পাল খাটাইয়া স্টেজ বাধিয়া এই বালীকিপ্রতিভার অভিনয় হইল । তাহাতে আমি বাল্মীকি সাজিয়াছিলাম । রঙ্গমঞ্চে আমার এই প্ৰথম অবতারণ । দর্শকদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন ; তিনি এই গীতিনাট্যের অভিনয় দেখিয়া তৃপ্তিপ্রকাশ করিয়াছিলেন । "ইহার পরে ‘দশরথকর্তৃক মৃগভ্ৰমে মুনিবালকবধ’ ঘটনা অবলম্বন করিয়া গীতিনাট্য লিখিয়ছিলাম। তাহাও অভিনীত হইয়াছিল। আমি তাহাতে অন্ধমুনি সাজিয়াছিলাম। এই গীতিনাট্যের অনেকগুলি গান পরে বাল্মীকিপ্রতিভার অন্তৰ্গত হইয়া তাহারই পুষ্টিসাধন করিয়াছে।” -প্রথম পাণ্ডুলিপি দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপি এবং “প্রবাসীতে ‘গীতচর্চা অধ্যায়ের শেষাংশ ছিল : । ‘জ্যোতিদাদার পিয়ানোযন্ত্র যখন খুব চলিতেছে সেই সময়ে সেই উৎসাহেই কতক তাহার সুরে কতক হিন্দি গানের সুরে বাল্মীকিপ্রতিভা গীতিনাট্য রচনা করিয়াছিলাম। ২৯ গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর -রচিত ব্ৰহ্মসংগীত ।