পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১০৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

S O SR রবীন্দ্র-রচনাবলী মৃদু বাতাস বহিতেছে, কুঞ্জে জ্যোৎস্না ফুটিয়াছে, চাদনী রাত্রে কোকিল ডাকিতেছে, এবং সেই কুঞ্জে, সেই বাতাসে, সেই জোৎস্নায়, সেই কোকিলের কুহুরবে, কুসুম-শয়ানে মুদিত নয়ানে, দুটি উলসিত অলসিত অরবিন্দের মতো, শ্যামের কোলে রাধা- চাঁদের উপরে চাদ ঘুমাইয়া আছে কী মধুর!!! কী সুন্দর! এত সৌন্দৰ্য স্তরে স্তরে একত্রে গাথা হইয়াছে- সৌন্দর্যের পাপড়ির উপরে পাপড়ি বিন্যাস হইয়াছে যে, সবসুদ্ধ লইয়া একটি সৌন্দর্যের ফুল, একটি সৌন্দর্যের শতদল ফুটিয়া উঠিয়াছে। “ও সুখ কো কারু অম্ভ”- এমন মিলন কোথায় হইয়া থাকে! না! বসন্তরায় প্রায় মাঝে মাঝে বস্তুগত বৰ্ণনা দূর করিয়া দিয়া এক কথায় এমন একটি ভাবের আকাশ খুলিয়া দেন, যে, আমাদের কল্পনা পাখা ছড়াইয়া উড়িয়া যায়, মেঘের মধ্যে হারাইয়া যায়! এক স্থলে আছে- “রায় বসন্ত কহে ও রূপ পিরীতিময়।” রূপকে পিরীতিময় বলিলে যাহা বলা হয়, আর কিছুতে তাহার অপেক্ষা অধিক বলা যায় না। যেখানে বসন্তরায় শ্যামের রূপকে বলিতেছেন কমনীয়া কিশোর কুসুম অতি সুকোমল কেবল রস নিরমাণ সেখানে কবি এমন একটি ভাব আনিয়াছেন যাহা ধরা যায় না, ছোওয়া যায় না । সেই ধরা-ছোওয়া দেয় না- এমন একটি ভাবকে ধরিবার জন্য কবি যেন আকুল বাকুল হইয়া পডিয়াছেন ; “কমনীয়” “কিশোর” “সুকোমল” প্রভৃতি কত কথাই ব্যবহার করিলেন, কিছুতেই কুলাইয়া উঠিল না— অবশেষে আকার প্রকার নাই । শ্ৰীকৃষ্ণ রাধাকে বলিতেছেন আলো ধনি, সুন্দরি, কি আর বলিব ? তোমা না দেখিয়া আমি কেমনে রহিব ? তোমার মিলন মোর পুণাপুঞ্জরাশি, মরমে লাগিছে মধুর মৃদু হাসি । বাঞ্ছাকল্পলতা মোর কামনামূরতি { সঙ্গের সঙ্গিনী তুমি সুখময় ঠাম | পাসরিব কেমনে জীবনে বাধা নাম রায় বসন্ত কহে প্ৰাণের গুরুতর। এমন প্ৰশান্ত উদার গভীর প্ৰেম বিদ্যাপতির কোনো পদে প্ৰকাশ পাইয়াছে কিনা সন্দেহ ; ইহার কয়েকটি সম্বোধন চমৎকার ; রাধাকে যে কৃষ্ণ বলিতেছেন- তুমি আমার কামনার মূর্তি, আমার মূর্তিমতী কামনা— অর্থাৎ তুমি আমার মনের একটি বাসনা মাত্র, রাধারূপে প্রকাশ পাইতেছ, ইহা কী সুন্দর! তুমি আমার গলে বনমালা, তোমাকে পরিলে আমার শরীরতৃপ্তি হয়- না, তুমি তাহারও অধিক, তুমি আমার শরীর, আমাতে তোমাতে প্ৰভেদ আর নাই—না, শরীর না, তুমি শরীরের চেয়েও অধিক, তুমি আমার প্রাণ, সর্ব শরীরকে ব্যাপ্ত করিয়া যাহা রহিয়াছে, যাহার আবির্ভাবে শরীর বাচিয়া আছে, শরীরে চৈতন্য আছে, তুমি সেই প্ৰাণ-- রায়বসন্ত কহিলেন, না, তুমি তাহারও অধিক, তুমি প্ৰাণেরও গুরুতর, তুমি বুঝি প্রাণকে প্ৰাণ দিয়াছ, তুমি আছ বলিয়াই বুঝি প্ৰাণ আছে! ঐ যে বলা হইয়াছে “মরমে লাগিছে মধুর মৃদু হাসি!” ইহাতে হাসির মাধুর্য কী সুন্দর প্রকাশ পাইতেছে! বসম্ভের বাতাসটি গায়ে যেমন করিয়া লাগে, সুদূর বাঁশির ধ্বনি ক্যানের কাছে যেমন করিয়া মরিয়া যায় পদ্ম মৃণাল কঁপিয়া সরোবরে একটুখানি তরঙ্গ উঠিলে তাহা যেমন করিয়া তীরের কাছে আসিয়া