পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সমালোচনা ave রচি দিব গোলাপের শয্যা মনোমত, সুরভি ফুলের তোড়া দিব কত শত; লয়ে মেষ শিশুদের কোমল পশম বসন বুনিয়া দিব অতি অনুপম; সুন্দর পাদুকা এক করিয়া রচিত কটিবন্ধ গড়ি দিব গাথি তৃণজাল, মাঝেতে বসায়ে দিব একটি প্রবাল। এই সব সুখ যদি তোর মনে ধরে হ’ আমার প্ৰিয়তমা, আয় মোর ঘরে। হস্তিদন্তে গড়া এক আসনের 'পরে আহার আনিয়া দিবে দুজনের তরেদেবতার উপভোগ্য, মহাৰ্ঘ্য এমন, রাজতের পাত্রে দোহে করিব ভোজন। রাখাল-বালক যত মিলি একত্তরে নাচিবে গাইবে তোর আমোদের তরে। এই সব সুখ যদি মনে ধরে তব হ’ আমার প্ৰিয়তমা, এক সাথে রব' । এ কবিতাতে একটি বিশেষ ভাবকে সমগ্র রাখা হয় নাই। মাঝখানে ভাঙিয়া পডিয়াছে। যে বিশাল কল্পনায় একটি ভাব সমগ্ৰ প্ৰতিবিম্বিত হয়, যাহাতে জোড়াতাড়া দিতে হয় না, সে কল্পনা ইহাতে প্রকাশিত হয় নাই। অরণ্য পর্বত প্ৰান্তরে যত কিছু সুখ পাওয়া যায়, তাহাই যে রাখালের আয়ত্তাধীনযে ব্যক্তি গোলাপের শয্যা ফুলের টুপি ও পাতার আঙিয়া নির্মাণ করিয়া দিবার লোভ দেখাইতেছে সে স্বর্ণখচিত পাদুকা, রাজতের পাত্ৰ, হস্তিদন্তের আসন পাইবে কোথায়? তুণনির্মিত কটিবন্ধের মধ্যে কি প্রবাল শোভা পায় ? কবিকঙ্কণের কমলে-কামিনীতে একটি রূপসী ষোড়শী হস্তী গ্রাস ও উদগার করিতেছে, ইহাতে এমন পরিমাণ সামঞ্জস্যের অভাব হইয়াছে যে, আমাদের সৌন্দর্যজজ্ঞানে অত্যন্ত আঘাত দেয়।* শিক্ষিত, সংযত, মার্জিত কল্পনায় একটি রূপসী যুবতীর সহিত গজাহার ও উদগীরণ

  • অনেকে তর্ক করেন যে, গণেশকে দুৰ্গা এক-একবার করিয়া চুম্বন করিতেছিলেন, তাহাই দূর হইতে দেখিয়া ধনপতি গজাহার ও উদগীরণ কল্পনা করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহা যথার্থ নহে। কারণ, কবিকঙ্কণচণ্ডীতেই আছে যে, চৌষটি যোগিনী পদ্মের দলরূপ ধারণ করিল, ও জয়া হস্তিনীরূপে রূপান্তরিত হইল। অতএব গণেশের সহিত ইহার কোনো সম্পর্ক নাই। কেহ বা তর্ক করেন যে, যখন কবির উদ্দেশ্য বিস্ময় ভাবের উদ্দীপন করা, তখন, বর্ণনা যাহাতে অদ্ভুত হয় তাহারই প্রতি কবির লক্ষা। কিন্তু এ কথার কোনো অর্থ নাই। সুকল্পনার সহিত বিস্ময় রসের কোনো মনান্তর নাই।

যখন কবি অগাধ সমুদ্রের মধ্যে মর্যালশোভিত কুমুদ কিছুর পদ্ম বনের মধ্যে এক রূপসী ষোড়শী প্রতিষ্ঠিত করিলেন- সমস্তই সুন্দর, নীল জল, সুকুমার পদ্ম, পুষ্পের সুগন্ধ, ভ্রমরের শুeন, ইত্যাদি— তখন মধ্য হইতে এক গজাহার আনিয়া আমাদের কল্পনায় আমন একটা নিদারুণ আঘাত দিবার তাৎপর্য কি ? সুন্দর পদার্থ যেমন কবিত্বপূর্ণ বিস্ময় উৎপন্ন করিতে পারে, এমন কি আর কিছুতে পারে? অপাের সমুদ্রের মধ্যে পদ্মাসীনা ষোড়শী রমণীই কি যথেষ্ট বিস্ময়ের কারণ নহে?