পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডুবি రీ: 4 যোগেন্দ্র চলিয়া গেলে অন্নদাবাৰু জিজ্ঞাসা করিলেন, “নলিনবাবু, আপনি এখন কোথায় আছেন ?” নলিনাক্ষ হাসিয়া কহিল, “আমি যে বিশেষ কোথাও আছি তাহ বলিতে পারি না । আমার জানাশুনা লোক অনেক আছেন, তাহারা আমাকে টানাটানি করিয়া লইয়া বেড়ান। আমার সে মন্দ লাগে না। কিন্তু মানুষের চুপ করিয়া থাকারও প্রয়োজন আছে। তাই যোগেনবাৰু আমার জন্য আপনাদের বাড়ির ঠিক পাশের বাড়িতেই স্থান করিয়া দিয়াছেন। এ গলিটি বেশ নিভৃত বটে।” এই সংবাদে অন্নদাবাবু বিশেষ আনন্দপ্রকাশ করিলেন। কিন্তু তিনি যদি লক্ষ্য করিয়া দেখিতেন তো দেখিতে পাইতেন যে, কথাটা শুনিবামাত্র হেমনলিনীর মুখ ক্ষণকালের জন্য বেদনায় বিবর্ণ হইয়া গেল । ওই পাশের বাসাতেই রমেশ ছিল। ইতিমধ্যে চা তৈরির খবর পাইয়া সকলে মিলিয়া নীচে চা খাইবার ঘরে গেলেন । অন্নদাবাবু কহিলেন, “মা হেম, নলিনবাবুকে এক পেয়াল চা দাও।” নলিনাক্ষ কহিল, “না অন্নদাবাবু, আমি চ খাইব না।” অন্নদা। সেকি কথা নলিনবাবু! এক পেয়ালা চা— নাহয় তো কিছু মিষ্টি খান । নলিনাক্ষ । আমাকে মাপ করিবেন। অন্নদা। আপনি ডাক্তার, আপনাকে আর কী বলিব । মধ্যাহ্নভোজনের তিনচার ঘণ্টা পরে চায়ের উপলক্ষে খানিকটা গরম জল খাওয়া হজমের পক্ষে ষে নিতান্ত উপকারী । অভ্যাস না থাকে যদি, আপনাকে নাহয় খুব পাতলা করিয়া চা তৈরি করিয়া দিই । নলিনাক্ষ চকিতের মধ্যে হেমনলিনীর মুখের দিকে চাহিয়া বুঝিতে পারিল যে, হেমনলিনী নলিনাক্ষের চা থাইতে সংকোচ সম্বন্ধে একটা কী আন্দাজ করিয়াছে এবং তাহাই লইয়া মনে মনে আন্দোলন করিতেছে । তৎক্ষণাং হেমনলিনীর দিকে চাহিয়া নলিনাক্ষ কহিল, “আপনি যাহা মনে করিতেছেন তাহ সম্পূর্ণ ঠিক নয়। আপনাদের এই চায়ের টেবিলকে আমি ঘৃণা করিতেছি বলিয়া মনেও করিবেন না। পূর্বে আমি যথেষ্ট চা খাইয়াছি, চায়ের গন্ধে এখনো আমার মনটা উংস্থক হয়— আপনাদের চা থাইতে দেখিয়া আমি আনন্দবোধ করিতেছি । কিন্তু আপনারা বোধ হয় জানেন না, আমার মা অত্যন্ত আচারপরায়ণা— আমি ছাড়া তাহার যথার্থ আপনার কেহ নাই— সেই মার কাছে আমি সংকুচিত হইয়া যাইতে পারিব না। এইজন্য আমি চ খাই না। কিন্তু আপনার চা খাইয়া যে সুখটুকু পাইতেছেন আমি তাহার ভাগ পাইতেছি। আপনাদের আতিথ্য হইতে আমি বঞ্চিত নহি ।”