পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডুবি ७११ থাকেন, তবে আজ কী বিপদেই পড়িয়াছেন বলুন দেখি। রমেশবাবু দিব্য নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিতে পারেন, কিন্তু আমি তো পারি না।” খুড়াকে সঙ্গে লইয়া অক্ষয় চলিয়া গেল । অন্নদাবাবু অত্যন্ত উদবিগ্ন হইয়া একবার হেমনলিনীর মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলেন। হেমনলিনী প্রাণপণে নিজেকে সংযত করিয়া বসিয়াছিল। সে জানিত, তাহার পিতা মনে মনে তাহার জন্য আশঙ্কা অনুভব করিতেছেন। হেমনলিনী কহিল, “বাবা, আজ একবার ডাক্তারকে দিয়া তোমার শরীরটা ভালো করিয়া পরীক্ষা করাও । একটুকুতেই তোমার স্বাস্থ্য নষ্ট হইয়া যায়, ইহার একটা প্রতিকার করা উচিত।” অন্নদাবাবু মনে মনে অত্যন্ত আরাম অনুভব করিলেন। রমেশকে লইয়া এতবড়ো আলোচনাটার পর হেমনলিনী যে র্তাহার পীড়া লইয়া উদবেগ প্রকাশ করিল, ইহাতে র্তাহার মনের মধ্য হইতে একটা ভার নামিয়া গেল। অন্য সময় হইলে তিনি নিজের পীড়ার প্রসঙ্গ উড়াইয়া দিতে চেষ্টা করিতেন ; আজ কহিলেন, “সে তো বেশ কথা । শরীরটা নাহয় পরীক্ষা করানোই যাক। তাহা হইলে আজ নাহয় একবার নলিনাক্ষকে ডাকিতে পাঠাই । কী বল ?” নলিনাক্ষ সম্বন্ধে হেমনলিনী একটুখানি সংকোচে পড়িয়া গেছে। পিতার সম্মুখে তাহার সহিত পূর্বের ন্যায় সহজভাবে মেলা তাহার পক্ষে কঠিন হইবে, তবু সে বলিল, “সেই ভালো, তাহাকে ডাকতে লোক পাঠাইয়া দিই।” অন্নদাবাৰু হেমের অবিচলিত ভাব দেখিয়া ক্রমে সাহস পাইয়া কহিলেন, “হেম, রমেশের এই-সমস্ত কাগু—” হেমনলিনী তৎক্ষণাং তাহাকে বাধা দিয়া কহিল, “বাবা, রৌদ্রের ঝাজ বাড়িয়া উঠিয়াছে— চলো, এখন ঘরে চলে।” বলিয়া তাহাকে আপত্তি করিবার অবসর না দিয়া হাত ধরিয়া ঘরে টানিয়া লইয়া গেল। সেখানে তাহাকে আরাম-কেদারায় বসাইয়া র্তাহার গায়ে বেশ করিয়া গরম কাপড় জড়াইয়া দিয়া তাহার হাতে একখানি খবরের কাগজ দিল এবং চশমার খাপ হইতে চশমাটি বাহির করিয়া নিজে তাহার চোখে পরাইয়া দিয়া কহিল, “কাগজ পড়ে, আমি আসিতেছি।” অন্নদাবাবু স্থবাধ্য বালকের মতো হেমনলিনীর আদেশ পালন করিতে চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কোনোমতেই মনোনিবেশ করিতে পারিলেন না। হেমনলিনীর জন্য তাহার মন উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিতে লাগিল। অবশেষে এক সময় কাগজ রাখিয়া হেমের খোজ করিতে গেলেন ; দোখলেন, সেই প্রাতে অসময়ে তাহার ঘরের দরজা বন্ধ।