পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডুবি Wobra ☾☾ দিনের মধ্যে অক্ষয় এক সময় চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছিল। তিনি তাহাকে কমলার প্রত্যাবর্তন সম্বন্ধে কোনো কথাই বলিলেন না। রমেশের প্রতি অক্ষয়ের যে বিশেষ বন্ধুভাব নাই, তাহ খুড়া বুঝিতে পারিয়াছেন। কমলা কেন চলিয়া গিয়াছিল, কোথায় চলিয়া গিয়াছিল, এ সম্বন্ধে বাড়ির কেহ কোনো প্রশ্নই করিল না— কমলা যেন ইহাদের সঙ্গেই কাশী বেড়াইতে আসিয়াছে, এমনিভাবে দিন কাটিয়া গেল । উমির দাই লছমনিয়া স্নেহমিশ্রিত ভংসনার ছলে কিছু বলিতে গিয়াছিল, খুড়া তৎক্ষণাৎ তাহাকে আড়ালে ডাকিয়া শাসন করিয়া দিয়াছিলেন । রাত্রে শৈলজা কমলাকে আপনার বিছানায় লইয়া শুইল । তাহার গলা জড়াইয়া ধরিয়া তাহাকে বুকের কাছে টানিয়া লইল, এবং দক্ষিণ হস্ত দিয়া তাহার গায়ে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল। এই কোমল হস্তস্পর্শ নীরব প্রশ্নের মতো কমলাকে তাহার গোপন বেদনার কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল । কমলা কহিল, “দিদি, তোমরা কী মনে করিয়াছিলে ? আমার উপরে রাগ কর নাই ?” শৈল কহিল, “আমাদের কি বুদ্ধিশুদ্ধি কিছু নাই ? আমরা কি এটা বুঝি নাই, সংসারে তোর যদি কোনো পথ থাকিত তবে তুই এই ভয়ানক পথ লইতিস না । আমরা কেবল এই বলিয়া কাদিয়াছি, ভগবান তোকে কেন এমন সংকটে ফেলিলেন । যে লোক কোনো অপরাধ করিতে জানে না, সেও দণ্ড পায় ।” কমলা কহিল, “দিদি, আমার সব কথা তুমি শুনিবে ?” শৈল স্নিগ্ধস্বরে কহিল, “শুনিব না তো কি বোন ?” কমলা । তখন যে তোমাকে কেন বলিতে পারি পাই, তাহ জানি না । তখন আমার কোনো কথা ভাবিয়া দেখিবার সময় ছিল না । হঠাৎ মাথায় এমন বজ্ৰাঘাত হইয়াছিল যে, লজ্জায় তোমার কাছে মুখ দেখাইতে পারিতেছিলাম না। সংসারে আমায় মা-বোন কেহ নাই, দিদি, তুমি আমার মা বোন দুই– তাই তোমার কাছে সব কথা বলিতেছি, নহিলে আমার যে কথা তাহা কাহারও কাছে বলিবার নয় । কমলা আর শুইয়া থাকিতে পারিল না, উঠিয়া বসিল । শৈলও উঠিয় তাহার সম্মুখে বসিল । সেই অন্ধকার বিছানার মধ্যে বসিয়া কমলা বিবাহ হইতে আরম্ভ করিয়া তাহার জীবনের কাহিনী বলিতে লাগিল ।