পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ ৩৩৯ > R বিপ্রদাস আরো কয়েকবার কুমুদিনীকে বুঝিয়ে বলবার চেষ্টা করলে। কুমু কথার জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে আঁচল খুঁটিতে লাগল। বিয়ের প্রস্তাব পাকা, কেবল একটা বিষয় নিয়ে দুই পক্ষে কিছু কথা-চালাচালি হল। বিয়েটা হবে কোথায় ? বিপ্রদাসের ইচ্ছে কলকাতার বাড়িতে। মধুসূদনের একান্ত জেদ নুরনগরে। বরপক্ষের ইচ্ছেই বাহাল রইল । k . আয়োজনের জন্যে কিছু আগে থাকতেই নুরনগরে আসতে হল । বৈশে* -জষ্টির খরার পরে আষাঢ়ের বৃষ্টি নামলে মাটি যেমন দেখতে দেখতে সবুজ হয়ে আসে, কুমুদিনীর অন্তরে-বাহিরে তেমনি একটা নূতন প্ৰাণের রঙ লাগল। আপন মনগড়া মানুষের সঙ্গে মিলনের আনন্দ ওকে অহরহ পুলকিত করে রাখে। শরৎকালের সোনার আলো ওর সঙ্গে চোখে চোখে কথা কইছে, কোন-এক অনাদিকালের মনের কথা । শোবার ঘরের সামনের বারান্দায় কুমু মুড়ি ছড়িয়ে দেয়, পাখিরা এসে খায় ; রুটির টুকরো রাখে, কাঠবিড়ালি চঞ্চল চােখে চারি দিকে চেয়ে দ্রুত ছুটে এসে লেজের উপর ভর দিয়ে দাঁড়ায় ; সামনের দুই পায়ে রুটি তুলে ধরে কুটুর-কুটুর করে খেতে থাকে। কুমুদিনী আড়াল থেকে আনন্দিত হয়ে বসে দেখে । বিশ্বের প্রতি ওর অন্তর আজ দাক্ষিণ্যে ভরা । বিকেলে গা ধোবার সময় খিড়কির পুকুরে গলা ডুবিয়ে চুপ করে বসে থাকে, জল যেন ওর সর্বাঙ্গে আলাপ করে । বিকেলের । বাকী আলো পুকুরের পশ্চিম-ধারের বাতাবি-লেবু গাছের শাখার উপর দিয়ে এসে ঘন কালো জলের উপরে নিকষে সোনার রেখার মতো ঝিকিমিকি করতে থাকে ; ও চেয়ে চেয়ে দেখে, সেই আলোয় ছায়ায় ওর সমস্ত শরীরের উপর দিয়ে অনির্বচনীয় পুলকের কঁপনি বয়ে যায় । মধ্যাহ্নে বাড়ির ছাদের চিলেকোঠায় একলা গিয়ে বসে থাকে, পাশের জামগাছ থেকে ঘুঘুর ডাক কানে আসে। ওর যৌবন-মন্দিরে আজ যে দেবতার বরণ হচ্ছে ভাবঘন রসের রূপটি তার, কৃষ্ণরাধিকার যুগলরাপের মাধুর্য তার সঙ্গে মিশেছে। বাড়ির ছাদের উপরে এসরাজটি নিয়ে ধীরে ধীরে বাজায়, ওর দাদার সেই আজু মোর ঘরে আইল পিয়ারওয়া রোমে রোমে হরখীলা । রাত্রে বিছানায় বসে প্ৰণাম করে, সকালে উঠে বিছানায় বসে আবার প্রণাম করে । কাকে করে সেটা স্পষ্ট নয়- একটি নিরবলম্ব ভক্তির স্বতঃস্ফুর্ত উচ্ছস । কিন্তু মনগড়া প্ৰতিমার মন্দিরদ্বার চিরদিন তো রুদ্ধ থাকতে পারে না । কানাকানির নিশ্বাসের তাপে ও বেগে সে মূর্তির সুষমা যখন ঘা খেতে আরম্ভ করে তখন দেবতার রূপ টিকবে কী করে ? তখন ভক্তের বড়ো দুঃখের দিন । Im፡ একদিন তেলেনিপাড়ার বুড়ি তিনকড়ি এসে কুমুদিনীর মুখের সামনেই বলে বাসল, “হঁ্যা গা, আমাদের কুমুর কপালে কেমন রাজা জুটল ? ঐ যে বেদেনীদের গান আছে— এক-যে ছিল কুকুর-চাটা শেয়ালকাটার বন, কেটে করলে সিংহাসন । এ’ও সেই শেয়ালকাটা-বনের রাজা । ঐ তো রজবপুরের আন্দো মুহুরির ছেলে মোধো । দেশে যোবার আকাল, মগের মুলুক থেকে চাল আনিয়ে বেচে ওর টাকা। তবু বুড়ি মাকে শেষদিন পর্যন্ত রাধিয়ে রাধিয়ে হাড় কালি করিয়েছে।” মেয়েরা উৎসুক হয়ে তিনকড়িকে ধরে বসে ; বলে, “বরকে জানতে নাকি ?” “জানতুম না ? ওর মা যে আমাদের পাড়ার মেয়ে, পুরুতি চক্রবর্তদের ঘরের। (গলা নিচু করে) সত্যি কথা বলি বাছা, ভালো বামনের ঘরে ওদের বিয়ে চলে না। তা হােক গে, লক্ষ্মী তো জাতবিচার করেন না ।” ጾ