পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ SBbyrd প্রতিবেশীর আস্তাবলে একটা কুকুরের বাচ্ছকে বেঁধে রেখেছে- রাত্রির শান্তি ঘুলিয়ে দিয়ে উঠছে তারই অশ্রান্ত আর্তনাদ । সময় একটা অতলস্পর্শ গর্তের মতো শূন্য হয়ে যেন হী করে আছে। মধুসূদনের সংসারের কলের সমস্ত চাকাই যেন বন্ধ । কাল তার আপিসের অনেক কাজ, ডাইরেক্টারদের মীটিং- কতকগুলো কঠিন প্ৰস্তাব অনেকের বাধা সত্ত্বেও কৌশলে পাস করিয়ে নিতে হবে । সে-সমস্ত জরুরি ব্যাপার। আজ তার কাছে একেবারে ছায়ার মতো । আগে হলে কালকের দিনের কার্যপ্ৰণালী আজ রাত্রে নোটবইয়ে টুকে রাখত। সব চিন্তা দূর হয়ে গেল, জগতে যে কঠিন সত্য সুনিশ্চিত সে হচ্ছে চাদর দিয়ে ঢাকা ঐ মেয়ে, ঘরের থেকে বেরিয়ে যাবার পথে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে । খানিক বাদে মধুসূদন একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে, ঘরটা যেন ধ্যান ভেঙে চমকে উঠল। দ্রুত চৌকি থেকে উঠে কুমুর কাছে গিয়ে বললে, “বড়োবাউ, তোমার মন কি পাথরে গড় ?” ঐ বড়োবউ শব্দটা কুমুর মনে মন্ত্রের মতো কাজ করে। নিজের মধ্যে তার মায়ের জীবনের অনুবৃত্তি হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে । এই ডাকে তার মা কতদিন কত সহজে সাড়া দিয়েছিলেন, তারই অভ্যাসটা যেন কুমুরও রক্তের মধ্যে। তাই চকিতে সে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াল। মধুসূদন গভীর কাতরতার সঙ্গে বললে, “আমি তোমার অযোগ্য, কিন্তু আমাকে কি দয়া করবে না ?” কুমুদিনী ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল, “ছি ছি, আমন করে বোলো না।” মাটিতে পড়ে মধুসূদনের পায়ের মধুসূদন তাকে হাত ধরে তুলে নিয়ে বুকে চেপে ধরলে, বললে, “না, তোমাকে আদেশ করব না, তুমি আপন ইচ্ছাতে আমার কাছে এসো ।” কুমুদিনী মধুসূদনের বাহুবন্ধনে হাঁপিয়ে উঠল। কিন্তু নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করলে না। মধুসূদন রুদ্ধপ্ৰায় কণ্ঠে বললে, “না, তোমাকে আদেশ করব না, তবু তুমি আমার কাছে এসো।” এই বলে কুমুদিনীকে ছেড়ে দিলে । কুমুদিনীর গৌরবর্ণ মুখ লাল হয়ে উঠেছে। সে চোখ নিচু করে বললে, “তুমি আদেশ করলে আমার কর্তব্য সহজ হয় । আমি নিজে ভেবে কিছু করতে পারি। নে ৷” “আচ্ছা, তুমি তোমার ঐ গায়ের চাদরখানা খুলে ফেলো- ওটাকে আমি দেখতে পারছি নে ৷” সসংকোচে কুমুদিনী চাদরখানা খুলে ফেললে । গায়ে ছিল একখানি ডুরে শাড়ি, সরু পাড়ের । কালো ডোরার ধারাগুলি কুমুদিনীর তনুদেহটিকে ঘিরে, যেন তারা রেখার ঝরনা- থেমে আছে মনে হয় না, কেবলই যেন চলছে- যেন কোনো-একটি কালো দৃষ্টি আপন অশ্রান্ত গতির চিহ্ন রেখে রেখে ওর অঙ্গকে ঘিরে ঘিরে প্রদক্ষিণ করছে, কিছুতে শেষ করতে পারছে না। মুগ্ধ হয়ে গেল মধুসূদন, অথচ সেই মুহুর্তে একটু লক্ষ্য না করে থাকতে পারলে না যে, ঐ শাড়িটি এখানকার দেওয়া নয় । কুমুদিনীকে যতই মানাক না কেন, এর দাম তুচ্ছ এবং এটা ওর বাপের বাড়ির। ঐ নাবার ঘরের সংলগ্ন কাপড় ছাড়বার ঘরে আছে দেরাজিওয়ালা, মেহগনি কাঠের মস্ত আলমারি, তার আয়না-দেওয়া পাল্লা- বিবাহের পূর্ব হতেই নানা রকমের দামি কাপড়ে ঠাসা । সেগুলির উপরে লোভ নেইমেয়ের এত গর্ব ! মনে পড়ে গেল সেই তিনটে আংটির কথা, অসহ্য ঔদাসীন্যে তাকে কুমুগ্ৰহণ করে নি, অথচ একটা লক্ষ্মীছাড়া নীলার আংটির জন্যে কত আগ্ৰহ! বিপ্রদাস আর মধুসূদনের মধ্যে কুমুর মমতার কত মূল্যভেদ ! চাদর খোলবামাত্র এই সমস্ত কথা দমকা ঝড়ের মতো মধুসূদনকে প্রকাণ্ড । ধাক্কা দিলে। কিন্তু হায় রে, কী সুন্দর, কী আশ্চর্য সুন্দর । আর এই দৃপ্ত অবজ্ঞা, সেও যেন ওর অলংকার । এই মেয়েই তো পারে ঐশ্বৰ্যকে অবজ্ঞা করতে । সহজ সম্পদে মহীয়সী হয়ে জন্মেছেওকে ধনের দাম কষ্যতে হয় না, হিসেব রাখতে হয় না- মধুসূদন ওকে কী দিয়ে লোভ দেখাতে মধুসূদন বললে, “যাও, তুমি শুতে যাও।” কুমু ওর মুখের দিকে চেয়ে রইল।-- নীরব প্রশ্ন এই যে, “তুমি আগে বিছানায় যাবে না ?”