পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ 8vo) দেবতার চেয়ে দাদার বিচারের উপর ভর করলে এত বিপদ ঘটত না । তবুও মনের মধ্যে যে - দেবতাকে নিয়ে দ্বিধা উঠেছে, হৃদয়ের মধ্যে তঁাকে এড়াতে পারি নে। ফিরে ফিরে সেইখানে এসে লুটিয়ে পড়ি ।” “তোমার কথা শুনে যে ভয় লাগে ।। ঘরে কি যাবেই না ?” “কোনো কালেই যাব না। সে কথা ভাবা শক্ত, যাবই সে কথাও সহজ নয় ।” “আচ্ছা, তোমার দাদার কাছে একবার কথা বলে দেখব । দেখি তিনি কী বলেন । তার দর্শন পাওয়া যাবে তো ?” “চলো-না, এখনই নিয়ে যাচ্ছি।” - বিপ্রদাসের ঘরে ঢুকেই তার চেহারা দেখে মোতির মা থমকে দাঁড়াল, মনে হল যেন ভূমিকম্পের পরোকার আলো-নেবা চুড়ো-ভাঙা মন্দির। ভিতরে একটা অন্ধকার আর নিস্তব্ধতা। প্ৰণাম করে পায়ের ধুলো নিয়ে মেজের উপর বসল। বিপ্ৰদাস ব্যস্ত হয়ে বললে, “এই যে চৌকি আছে ।” মোতির মা মাথা নেড়ে বললে, “না, এখানে বেশ আছি।” ঘোমটার ভিতর থেকে তার চোখ ছল ছল করতে লাগল। বুঝতে পারলে দাদার এই অবস্থায় কুমুকে ব্যথাই বাজছে । কুমু প্ৰসঙ্গটা সহজ করে দেবার জন্যে বললে, “দাদা, ইনি বিশেষ করে এসেছেন তোমার মত জিজ্ঞাসা করতে ।” মোতির মা বললে, “না না, মত জিজ্ঞাসা পরের কথা, আমি এসেছি ওঁর চরণ দর্শন করতে ।” কুমু বললে, “উনি জানতে চান, ওঁদের বাড়িতে আমাকে যেতে হবে কি না।” বিপ্রদাস উঠে বসিল ; বললে, “সে তো পরের বাড়ি, সেখানে কুমু গিয়ে থাকবে কী করে ?” যদি ক্ৰোধের সুরে বলত তা হলে কথাটার ভিতরকার আগুন। এমন করে জ্বলে উঠত না । শান্ত কণ্ঠস্বর, মুখের মধ্যে উত্তেজনার লক্ষণ নেই। মোতির মা ফিস ফিস করে কী বললে। তার অভিপ্ৰায় ছিল পাশে বসে কুমু তার কথাগুলো বিপ্রদাসের কানে পৌঁছিয়ে দেবে। কুমু সম্মত হল না, বললে, “তুমিই গলা ছেড়ে বলে ।” মোতির মা স্বর আর-একটু স্পষ্ট করে বললে, “যা ওঁর আপনারই, কেউ তাকে পরের করে দিতে পারে না, তা সে যেই হােক-না ।” “সে কথা ঠিক নয় । উনি আশ্রিত মাত্র । ওঁর নিজের অধিকারের জোর নেই। ওঁকে ঘরছাড়া করলে হয়তো নিন্দা করবে, বাধা দেবে না। যত শাস্তি সমস্তই কেবল ওঁর জন্যে। তবু অনুগ্রহের আশ্রয়ও সহ্য করা যেত যদি তা মহাদাশ্রয় হত ।” এমন কথার কী জবাব দেবে মোতির মা ভেবে পেলে না। স্বামীর আশ্রয়ে বিঘ্ন ঘটলে মেয়ের পক্ষের লোকেরাই তো পায়ে ধরাধরি করে, এ-যে উলটো কাণ্ড । কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, “কিন্তু আপনি সংসার না থাকলে মেয়েরা যে বঁাচে না ; পুরুষেরা ভেসে বেড়াতে পারে, মেয়েদের কোথাও স্থিতি চাই তো ।” “স্থিতি কোথায় ? অসম্মানের মধ্যে ? আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি, কুমুকে যিনি গড়েছেন তিনি আগাগোড়া পরম শ্ৰদ্ধা করে গড়েছেন । কুমুকে অবজ্ঞা করে এমন যোগ্যতা কারও নেই, চক্রবর্তী-সম্রাটেরও না ।” কুমুকে মোতির মা খুবই ভালোবাসে, ভক্তি করে, কিন্তু তবু কোনো মেয়ের এত মূল্য থাকতে পারে যে তার গৌরব স্বামীকে ছাপিয়ে যাবে। এ কথা মোতির মা'র কানে ঠিক লাগল না । সংসারে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়াঝাটি চলুক, স্ত্রীর ভাগ্যে অনাদর-অপমানও না-হয় যথেষ্ট ঘটল, এমন-কি, তার থেকে নিস্কৃতি পাবার জন্যে স্ত্রী আফিম খেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে মরে সেও বোঝা যায়, কিন্তু তাই বলে স্বামীকে একেবারে বাদ দিয়ে স্ত্রী নিজের জোরে থাকবে এটাকে মেতির মা স্পর্ধা বলেই মনে করে। ,