পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শেষের কবিতা 89 কোনোদিনই ঠিক কথাটি অকুষ্ঠিত স্বরে বলবার দৈবশক্তি আর জোটে না। যেদিন সেই বাণী আসে সেদিন সমস্ত পৃথিবীকে ডেকে খবর দিতে ইচ্ছে করে- শোনো তোমরা, আমি ভালোবাসি। আমি ভালোবাসি, এই কথাটি অপরিচিত।-সিন্ধুপার-গামী পাখির মতো কত দিন থেকে, কত দূর থেকে আসছে । সেই কথাটির জন্যেই আমার প্রাণে আমার ইষ্টদেবতা এত দিন অপেক্ষা করছিলেন । স্পর্শ করল। আজ সেই কথাটি- আমার সমস্ত জীবন, আমার সমস্ত জগৎ সত্য হয়ে উঠল । বালিশের মধ্যে মুখ লুকিয়ে লাবণ্য আজ কাকে এমন করে বলতে লািগল- সত্য, সত্য, এত সত্য আর কিছু নেই। সময় চলে গেল, অতিথি এল না। অপেক্ষার গুরুভারে বুকের ভিতরটা টনটন করতে লাগল, বারান্দায় বেরিয়ে গিয়ে লাবণ্য খানিকটা ভিজে এল জলের ঝাপটা লাগিয়ে । তার পরে একটা গভীর অবসাদে তার মনটাকে ঢেকে ফেললে- নিবিড় একটা নৈরাশ্যে ; মনে হল, ওর জীবনে যা জ্বলবার তা একবার মাত্র দপ করে জ্বলে তার পরে গেল নিবে, সামনে কিছুই নেই। অমিতকে নিজের ভিতরকার সত্যের দোহাই দিয়ে সম্পূর্ণ করে স্বীকার করে নিতে ওর সাহস চলে গেল। এই কিছু আগেই ওর প্রবল যে-একটা ভরসা জেগেছিল সেটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। অনেকক্ষণ চুপ করে পড়ে থেকে অবশেষে টেবিল থেকে বইটা টেনে নিলে। কিছু সময় গেল মন দিতে, তার পরে গল্পের ধারার মধ্যে প্রবেশ করে কখন নিজেকে ভুলে গেল তা জানতে পারে নি । এমন সময় যোগমায়া ডাকলেন বেড়াতে যেতে, ওর উৎসাহ হল না । যোগমায়া একটা চৌকি টেনে লাবণ্যর সামনে বসলেন, দীপ্ত চোখ তার মুখে রেখে বললেন, “সত্যি করে বলে দেখি লাবণ্য, তুমি কি অমিতকে ভালোবাস।” লাবণ্য তাড়াতাড়ি উঠে বসে বললে, “এমন কথা কেন জিজ্ঞাসা করছি কর্তা-মা ।” “যদি না ভালোবাস, ওকে স্পষ্ট করেই বল-না কেন । নিষ্ঠুর তুমি, ওকে যদি না চাও তবে ওকে ধরে রেখো না ।” লাবণ্যর বুকের ভিতরটা ফুলে ফুলে উঠল, মুখ দিয়ে কথা বেরোল না। “এই মাত্র যে দশা ওর দেখে এলুম। বুক ফেটে যায়। এমন ভিক্ষুকের মতো কার জন্যে এখানে ও পড়ে আছে। ওর মতো ছেলে যাকে চায় সে যে কতবড়ো ভাগ্যবতী তা কি একটুও বুঝতে পার না।” চেষ্টা করে রুদ্ধ কণ্ঠের বাধা কাটিয়ে লাবণ্য বলে উঠল, “আমার ভালোবাসার কথা জিজ্ঞাসা করছি কর্তা-মা ? আমি তো ভেবে পাই নে, আমার চেয়ে ভালোবাসতে পারে পৃথিবীতে এমন কেউ আছে। ভালোবাসায় আমি যে মরতে পারি। এতদিন যা ছিলুম সব যে আমার লুপ্ত হয়ে গেছে। এখন থেকে আমার আর-এক আরম্ভ, এ আরম্ভের শেষ নেই। আমার মধ্যে এ যে কত আশ্চর্য সে আমি কাউকে কেমন করে জানাব । আর কেউ কি এমন করে জেনেছে ।” যোগমায়া অবাক হয়ে গেলেন । চিরদিন দেখে এসেছেন লাবণ্যর মধ্যে গভীর শক্তি, এতবড়ো দুঃসহ আবেগ কোথায় এতদিন লুকিয়ে ছিল। তাকে আস্তে আস্তে বললেন, “মা লাবণ্য, নিজেকে চাপা দিয়ে রেখো না । অমিত অন্ধকারে তোমাকে খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছে- সম্পূর্ণ করে তার কাছে তুমি আপনাকে জানাও, একটুও ভয় কোরো না । যে আলো তোমার মধ্যে জ্বলেছে সে আলো যদি তার কাছেও প্রকাশ পেত তা হলে তার কোনো অভাব থাকত না । চলো মা, এখনই চলে আমার সঙ্গে ।” দুজনে গেলেন অমিতার বাসায় । So দ্বিতীয় সাধনা তখন অমিত ভিজে চৌকির উপরে এক তাড়া খবরের কাগজ চাপিয়ে তার উপর বসেছে। টেবিলে এক দিন্তে ফুলস্ক্যাপ কাগজ নিয়ে তার চলছে লেখা । সেই সময়েই সে তার বিখ্যাত আত্মজীবনী শুরু করেছিল। কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলে, সেই সময়েই তার জীবনটা অকস্মাৎ তার নিজের কাছে দেখা