পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট “ । ৩৭৫ ৷ আমি মাঝে মাঝে পলাইয়া রায়গড়ে দাদামহাশয়ের কাছে যাইতাম । পিত৷ বড়ো একটা খোজ লইতেন না। আঃ, সে কী পরিবর্তন । সেখানে গাছপালা দেখিতে পাইতাম, গ্রামবাসীদের কুটিরে যাইতে পারিতাম, দিবানিশি রাজবেশ পরিয়া থাকিতে হইত না । তাহ ছাড়া জান তো, যেখানে দাদামহাশয় থাকেন, তাহার ত্রিসীমায় বিষাদ ভাবনা বা কঠোর গম্ভীর্ষ তিষ্ঠিতে পারে না । গাহিয়া বাজাইয়া, আমোদ করিয়া চারিদিক পূর্ণ করিয়া রাখেন। চারিদিকে উল্লাস, সম্ভাব, শাস্তি। সেইখানে গেলেই আমি ভুলিয়া যাইতাম যে, আমি যশোহরের যুবরাজ। সে কী আরামের ভুল । অবশেষে আমার বয়স যখন আঠারো বৎসর, একদিন রায়গড়ে বসন্তের বাতাস বহিতেছিল, চারিদিকে সবুজ কুঞ্জবন, সেই বসন্তে আমি রুক্মিণীকে দেখিলাম।” সুরমা বলিয়া উঠিল, “ও-কথা অনেক বার শুনিয়াছি।” উদয়াদিত্য । আর-একবার শুন । মাঝে মাঝে এক-একটা কথা প্রাণের মধ্যে ংশন করিতে থাকে, সে-কথাগুলা যদি বাহির করিয়া না দিই, তবে আর বঁচিব কী করিয়া । সেই কথাটা তোমার কাছে এখনও বলিতে লজ্জা করে, কষ্ট হয়, তাই বারবার করিয়া বলি। যেদিন আর লজ্জা করিবে না, কষ্ট হইবে না, সেদিন বুঝিৰ আমার প্রায়শ্চিত্ত শেষ হইল, সেদিন আর বলিব না । সুরমা । কিসের প্রায়শ্চিত্ত প্রিয়তম ? তুমি যদি পাপ করিয়া থাক তো সে পাপের দোষ, তোমার দোষ নহে । আমি কি তোমাকে জানি না ? অন্তৰ্বামী কি তোমার মন দেখিতে পান না ? উদয়াদিত্য বলিতে লাগিলেন, ‘রুক্মিণীর বয়স আমার অপেক্ষ তিন বৎসরের বড়ো। সে একাকিনী বিধবা । দাদামহাশয়ের অনুগ্রহে সে রায়গড়ে বাস করিতে পাইত। মনে নাই, সে আমাকে কী কৌশলে প্রথমে আকর্ষণ করিয়া লইয়া গেল। তখন আমার মনের মধ্যে মধ্যাহের কিরণ জলিতেছিল। এত প্রখর আলো যে, কিছুই ভালো করিয়া দেখিতে পাইতেছিলাম না, চারিদিকে জগৎ জ্যোতির্ময় বাম্পে আবৃত। সমস্ত রক্ত যেন মাথায় উঠিতেছিল ; কিছুই আশ্চর্ষ, কিছুই অসম্ভব মনে হুইত না ; পথ বিপথ, দিক বিদিক সমস্ত এক আকার ধারণ করিয়াছিল। ইহার পূর্বেও আমার এমন কখনো হয় নাই, ইহার পরেও আমার এমন কখনো হয় নাই । জগদীশ্বর জানেন, তাহার কী উদেশু সাধন করিতে এই ক্ষুদ্র দুর্বল বুদ্ধিহীন হৃদয়ের বিরুদ্ধে এক দিনের জন্য সমস্ত জগৎকে যেন উত্তেজিত করিয়া দিয়াছিলেন, বিশ্বচরাচর যেন একতন্ত্র হইয়া আমার এই ক্ষুদ্র হৃদয়টিকে মুহূর্তে বিপথে লইয়া গেল । মুহূর্তমাত্র—আর অধিক নয়-সমস্ত বহির্জগতের মুহূর্তস্থায়ী এক নিদারুণ আঘাত,