পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট ৪৪৯ । উদয়াদিত্যের অর্ধেক বল অর্ধেক প্রাণ চলিয়া গিয়াছে। প্রত্যেক কাজে ষে তাহার অশি ছিল, উৎসাহ ছিল, যাহার মন্ত্রণ র্তাহার একমাত্র সহায় ছিল, যাহার হাসি তাহার একমাত্র পুরস্কার ছিল—সে-ই চলিয়া গেল। তিনি র্তাহার শয়নগৃহে যাইতেন, যেন কী ভাবিতেন, একবার চারিদিকে দেখিতেন, দেখিতেন—কেহ নাই । ধীরে ধীরে সেই বাতায়নে আসিয়া বসিতেন ; যেখানে সুরমা বলিত সেইখানটি শূন্ত রাখিয়া দিতেন—আকাশে সেই জ্যোৎস্না, সম্মুখে সেই কানন, তেমনি করিয়া বাতাস বহিতেছে— মনে করিতেন, এমন সন্ধ্যায় সুরমা কি না আসিয়া থাকিতে পারিবে ? সহসা তাহার মনে হইত, যেন সুরমার মতে কার গলার স্বর শুনিতে পাইলাম, চমকিয়া উঠিতেন, যদিও অসম্ভব মনে হইত, তবু একবার চারিদিক দেখিতেন, একবার বিছানায় যাইতেন, দেখিতেন—কেহ আছে কি না । যে উদয়াদিত্য সমস্ত দিন শত শত ক্ষুদ্র কাজে ব্যস্ত থাকিতেন, দরিদ্র প্রজারা তাহদের খেতের ও বাগানের ফলমূল শাকসবজি উপহার লইয়া তাহার কাছে আসিত, তিনি তাহাদের জিজ্ঞাসা-পড়া করিতেন, তাহাদের পরামর্শ দিতেন ; আজকাল আর সে-সব কিছুই করিতে পারেন না, তবুও সন্ধ্যাবেলায় শ্রান্ত হইয়া পড়েন শ্রাস্তপদে শয়নালয়ে আসেন, মনের মধ্যে যেন একটা অশি থাকে যে, সহসা শয়নকক্ষের দ্বার খুলিলেই দেখিতে পাইব—মুরমা সেই বাতায়নে বসিয়া অাছে। উদয়াদিত্য যখন দেখিতে পান, বিভা একাকী স্নানমুখে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, তখন তাহার প্রাণ কাদিয়া উঠে। বিভাকে কাছে ডাকেন, তাহাকে আদর করেন, তাহাকে কত কী স্নেহের কথা বলেন, অবশেষে দাদার হাত ধরিয়া বিভা কাদিয়া উঠে, উদয়াদিত্যেরও চোখ দিয়া জল পড়িতে থাকে। একদিন উদয়াদিত্য বিভাকে ডাকিয়া কছিলেন, “বিভা, এ-বাড়িতে আর তোর কে রহিল ? তোকে এখন শ্বশুরবাড়ি পাঠাইবার বন্দোবস্ত করিয়া দিই। কী বলিস ? আমার কাছে লজ্জা করিস না বিভা। তুই আর কার কাছে তোর মনের সাধ প্রকাশ করিবি বল ?” বিভা চুপ করিয়া রহিল। কিছু বলিল না। এ-কথা আর জিজ্ঞাসা করিতে হয় ? পিতৃভবনে কি আর তাহার থাকিতে ইচ্ছা করে ? পৃথিবীতে যে তাহার একমাত্র জুড়াইবার স্থল আছে, সেইখানে— সেই চন্দ্রদ্বীপে যাইবার জন্য তাহার প্রাণ অস্থির হইবে না তো কী ? কিন্তু তাহাকে লইতে এ-পর্যস্ত একটিও তো লোক আসিল না ! কেন আসিল না ? বিভাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাইবার প্রস্তাব উদয়াদিত্য একবার পিতার নিকট উত্থাপন করিলেন। প্রতাপাদিত্য কছিলেন, “বিভাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাইতে আমার কোনো আপত্তি নাই। কিন্তু তাহাদের নিকট যদি বিভার কোনো আদর থাকিত,