পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট 8ቆልዓ রায়ের মনে মনে বিলক্ষণ ভয় হইতেছিল। কিন্তু ঢালু পর্বতে বেগে নামিতে নামিতে হাজার ভয় হইলেও যেমন মাঝে মাঝে থামা যায় না, রামচন্দ্র রায়ের মনেও সেইরূপ একটা ভাবের উদয় হইয়াছিল । সহসা একটা দুঃসাহসিকতায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন, শেষ পর্ষপ্ত না পৌঁছিয়া যেন দাড়াইতে পারিতেছেন না। রামমোহনকে ডাকিয়া কহিলেন, “এই পত্র যশোহরে লইয়া য।” রামমোহন জোড়হস্তে কহিল, “আজ্ঞা না মহারাজ, আমি পারিব না। আমি স্থির করিয়াছি আর যশোহরে যাইব না। এক যদি পুনরায় মা-ঠাকুরানীকে আনিতে যাইতে বলেন তো আর-একবার যাইতে পারি, নতুবা এ চিঠি লইয়া যাইতে পারিব না।” রামমোহনকে আর কিছু না বলিয়া বৃদ্ধ নয়ানচাদের হাতে রাজা সেই পত্ৰখানি দিলেন। সে সেই পত্র লইয়া যশোহরে যাত্রা করিল। পত্র লইয়া গেল বটে, কিন্তু নয়ানচাদের মনে বড়ো ভয় হইল। প্রতাপাদিত্যের হাতে এ পত্র পড়িলে না জানি তিনি কী করিয়া বসেন। অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া মহিষীর হাতে সে এই পত্র দিতে সংকল্প করিল। মহিষীর মনের অবস্থা বড়ো ভালো নয় । একদিকে বিভার জন্য র্তাহার ভাবনা, আর-একদিকে উদয়াদিত্যের জন্ত তাহার কষ্ট । সংসারের গোলেমালে তিনি যেন একেবারে ঝালাপালা হইয়া গিয়াছেন । মাঝে মাঝে প্রায় তাহাকে কাদিতে দেখা যায়। র্তাহার যেন আর ঘরকন্নায় মন লাগে না। এইরূপ অবস্থায় তিনি এই পত্ৰখানি পাইলেন— কী যে করিবেন কিছু ভাবিয়া পাইলেন না । বিভাকে কিছু বলিতে পারেন না, তাহা হইলে সুকুমার বিভা আর বঁচিবে না । মহারাজের কানে এ চিঠির কথা উঠিলে কী যে অনৰ্থপাত হইবে তাহার ঠিকানা নাই। অথচ এমন সংকটের অবস্থায় কাহাকে কিছু না বলিয়া কাহারও নিকট কোনো পরামর্শ না লইয়া মহিষী বাচিতে পারেন না, চারিদিক অকুল পাথার দেখিয়া কাদিতে কঁাদিতে প্রতাপাদিত্যের কাছে গেলেন । কহিলেন, “মহারাজ, বিভার তো যাহা হয় একটা কিছু করিতে হইবে।” প্রতাপাদিত্য কহিলেন, “কেন বলে দেখি ?” মহিষী কহিলেন, “না:, কিছু যে হইয়াছে তাহা নহে তবে বিভাকে তো এক সময়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠাইতেই হইবে।” প্রতাপাদিত্য। “লে তো বুঝিলাম, তবে এতদিন পরে আজ যে সহসা তাহা মনে পড়িল ?” মহিষী ভীত হইয়া কছিলেন, “ওই তোমার এক কথা, আমি কি বলিতেছি যে কিছু হইয়াছে ? যদি কিছু হয়—”