পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৬১৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৫৩২ রবীন্দ্র-রচনাবলী সেখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারলেম না। মাথা ঘুরতে লাগল। ধরাধরি করে আবার আমার ক্যাবিনে এলেম। সেই যে বিছানায় পড়লেম, ছ-দিন আর এক মুহূর্তের জন্যও মাথা তুলি নি। আমাদের যে স্ট অর্ড ছিল (যাত্রীদের সেবক)— কারণ জানি নে— আমার উপর তার বিশেষ কৃপাদৃষ্টি ছিল। দিনের মধ্যে যখনতখন সে আমার জন্যে খাবার নিয়ে উপস্থিত করত ; না খেলে কোনোমতেই ছাড়ত না । সে বলত, না খেলে আমি ইদুরের মতো দুর্বল হয়ে পড়ব (weak as a rat) । সে বলত, সে আমার জন্যে সব কাজ করতে পারে। আমি তাকে যথেষ্ট সাধুবাদ দিতেম, এবং জাহাজ ছেড়ে আসবার সময় সাধুবাদের চেয়ে আরো কিঞ্চিৎ সারবান পদার্থ দিয়েছিলেম । ছ-দিনের পর আমরা যখন এডেনের কাছাকাছি পৌছলেম, তখন সমুদ্র কিছু শাস্ত হল। সেদিন আমার স্ট অর্ড এসে নড়ে চড়ে বেড়াবার জন্তে আমাকে বার বার অনুরোধ করতে লাগল। আমি তার পরামর্শ শুনে বিছানা থেকে তো উঠলেম, উঠে দেখি যে সত্যিই ইদুরের মতো দুর্বল হয়ে পড়েছি । মাথা যেন ধার-কর, কাধের সঙ্গে তার ভালো রকম বনে না ; চুরি-করা কাপড়ের মতো শরীরটা যেন আমার ঠিক গায়ে লাগছে না। ঘর থেকে বেরিয়ে ছাতের উপর গিয়ে একটা কেদারায় হেলান দিয়ে পড়লেম । অনেক দিনের পর বাতাস পেয়ে বাচলেম । দুপুরবেলা দেখি একটা ছোটাে নৌকা সেই সমুদ্র দিয়ে চলেছে। চারদিকে অনেক দূর পর্যন্ত আর ডাঙা নেই, জাহাজসুদ্ধ লোক অবাক । তারা আমাদের স্টীমারকে ডাকতে আরম্ভ করলে, জাহাজ থামল । তারা একটি ছোটো নৌকায় করে কতকগুলি লোক জাহাজে পাঠিয়ে দিলে । এরা সকলে আরবদেশীয়, এডেন থেকে মস্কটে যাচ্ছে। পথের মধ্যে দিকভ্রম হয়ে গেছে, তাদের সঙ্গে যা জলের পিপে ছিল, তা ভেঙে গিয়ে জল সমস্ত নষ্ট হয়ে গেছে, অথচ যাত্রী অনেক । আমাদের জাহাজের লোকেরা তাদের জল দিলে। একটি ম্যাপ খুলে কোন দিকে ও কত দূরে মস্কট, তাদের দেখিয়ে দিলে, তারা আবার চলতে লাগল। সে নৌকো যে মস্কট পর্যন্ত পৌছবে তাতে সকলেই সন্দেহ প্রকাশ করতে লাগল। ২৮শে সেপ্টেম্বর শনিবার সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি, আমাদের সম্মুখে সব পাহাড়-পর্বত উঠেছে। অতি সুন্দর পরিষ্কার প্রভাত, স্বৰ্ষ সবেমাত্র উঠেছে, সমুদ্র অতিশয় শাস্ত। দূর থেকে সেই পর্বতময় ভূভাগের প্রভাতদৃশ্ব এমন স্বন্দর দেখাচ্ছে যে কী বলব। পর্বতের উপরে রঙিন মেঘগুলি এমন নত হয়ে পড়েছে যে, মনে হয় যেন অপরিমিত সুর্যকিরণ পান করে তাদের আর দাড়াবার শক্তি নেই, পর্বতের