পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজর্ষি Q(公 আবশ্যক । এই সকল বিবেচনা করিয়া তিনি হঠাৎ আসিয়া ঘাড় নাড়িয়া কহিলেন, “ছি, ও কথা বলতে a该T” পুরোহিত ঠাকুরের অত্যন্ত আমোদ বোধ হইল। তিনি হাসিয়া উঠিলেন, ধ্রুবকে কোলে লইয়া চুমো খাইতে লাগিলেন । কিন্তু রাজা হাসিলেন না। তাহার মনে হইল যেন বালকের মুখে তিনি দৈববাণী শুনিলেন । তিনি অসন্দিগ্ধ স্বরে বলিয়া উঠিলেন, “ঠাকুর, আমি স্থির করিয়াছি এ রক্তপাত আমি ঘটিতে দিব না, আমি যুদ্ধ করিব না ।” বিন্ধন ঠাকুর কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন । অবশেষে কহিলেন, “মহারাজের যদি যুদ্ধ করিতেই আপত্তি থাকে, তবে আর-এক কাজ করুন। আপনি নক্ষত্ররায়ের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তঁহাকে যুদ্ধ হইতে বিরত করুন।” গোবিন্দমাণিক্য কহিলেন, “ইহাতে আমি সম্মত আছি।” বিম্বন কহিলেন, “তবে সেইরূপ প্ৰস্তাব লিখিয়া নক্ষত্ররায়ের নিকট পাঠানো হউক ৷” অবশেষে তাহাই স্থির হইল । চতুস্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ নক্ষত্ররায় সৈন্য লইয়া অগ্রসর হইতে লাগিলেন, কোথাও তিলমাত্র বাধা পাইলেন না। ত্রিপুরার যে গ্রামেই তিনি পদাপণ করিলেন সেই গ্রামই র্তাহাকে রাজা বলিয়া বরণ করিতে লাগিল । পদে পদে রাজত্বের আস্বাদ পাইতে লাগিলেন— ক্ষুধা আরো বাড়িতে লাগিল, চারি দিকের বিস্তৃত ক্ষেত্র, গ্ৰাম, পর্বতশ্রেণী, নদী সমস্তই, “আমার’ বলিয়া মনে হইতে লাগিল এবং সেই অধিকারব্যাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে নিজেও যেন অনেক দূর পর্যন্ত ব্যাপ্ত হইয়া অত্যন্ত প্রশস্ত হইয়া পড়িতে লাগিলেন । মোগল-সৈন্যেরা যাহা চায় তিনি তাহাই তাহাদিগকে লাইতে আলী-হুকুম দিয়া দিলেন । মনে হইল এ-সমস্তই আমার এবং ইহারা আমারই রাজ্যে আসিয়া পড়িয়াছে। ইহাদিগকে কোনাে সুখ হইতে বঞ্চিত করা হইবে না— স্বস্থানে ফিরিয়া গিয়া মোগলেরা তাহার আতিথ্যের ও রাজবৎ উদারতা ও বদ্যান্যতার অনেক প্ৰশংসা করিবে ; বলিবে, “ত্রিপুরার রাজা বড়ো কম রাজা নহে।’ মোগল-সৈন্যদের নিকট হইতে খ্যাতি লাভ করিবার জন্য তিনি সততই উৎসুক হইয়া রহিলেন । তাহারা তাহাকে কোনো প্রকার শ্রুতিমধুর সম্ভাষণ করিলে তিনি নিতান্ত জল হইয়া যান । সর্বদাই ভয় হয় পাছে কোনো নিন্দার কারণ ঘটে । রঘুপতি আসিয়া কহিলেন, “মহারাজ, যুদ্ধের তো কোনো উদযোগ দেখা যাইতেছে না ।” নক্ষত্ররায় কহিলেন, “না ঠাকুর, ভয় পাইয়াছে।” বলিয়া অত্যন্ত হাসিতে লাগিলেন । রঘুপতি হাসিবার বিশেষ কোনো কারণ দেখিলেন না, কিন্তু তথাপি হাসিলেন । নক্ষত্ররায় কহিলেন, “নক্ষত্ররায় নবাবের সৈন্য লইয়া আসিয়াছে। বড়ো সহজ ব্যাপার নহে ।” রঘুপতি কহিলেন, “দেখি এবার কে কাহাকে নির্বাসনে পাঠায় ! কেমন ?” নক্ষত্ররায় কহিলেন, “আমি ইচ্ছা করিলে নির্বাসনদণ্ড দিতে পারি, কারারুদ্ধ করিতেও পারি।-- বধের হুকুম দিতেও পারি। এখনো স্থির করি নাই কোনটা করিব।” বলিয়া অতিশয় বিজ্ঞভাবে অনেক বিবেচনা করিতে লাগিলেন । রঘুপতি কহিলেন, “অত ভাবিবেন না মহারাজ। এখনো অনেক সময় আছে। কিন্তু আমার ভয় হইতেছে, গোবিন্দমাণিক্য যুদ্ধ না করিয়াই আপনাকে পরাভূত করিবেন।” নক্ষত্ররায় কহিলেন, “ সে কেমন করিয়া হইবে ?” রঘুপতি কহিলেন, “গােবিন্দমাণিক্য সৈন্যগুলোকে আড়ালে রাখিয়া বিস্তর ভ্রাতৃস্নেহ দেখাইবেন। গলা ধরিয়া বলিবেন— ছােটাে ভাই আমার, এসো ঘরে এসো, দুধ-সর খাওসে। মহারাজ কঁাদিয়া