পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজর্ষি ARS আরম্ভ হইল। এই সময়ে মৃতদেহে পুষ্করিণীর জল দূষিত হইয়া এবং অন্যান্য নানা কারণে গ্রামে মড়ক আরম্ভ হইল। পাঠানদের পাড়ায় মড়কের প্রথম আরম্ভ হইল। মৃতদেহের গাের দিবার বা পরস্পরকে সেবা করিবার অবসর কাহারও রহিল না। হিন্দুরা কহিল, মুসলমানেরা গোহত্যিা-পাপের ফল ভোগ করিতেছে। জাতি-বৈরিতায় এবং জাতিচু্যুতিভয়ে কোনো হিন্দু তাহাদিগকে জল দিল না বা কোনো প্রকার সাহায্য করিল না। বিন্ধন সন্ন্যাসী যখন গ্রামে আসিলেন তখন গ্রামের এইরূপ অবস্থা। বিম্বনের কতকগুলি চেলা জুটিয়াছিল, মড়কের ভয়ে তাহারা পালাইবার চেষ্টা করিল। বিন্ধন ভয় দেখাইয়া তাহাদিগকে বিরত করিলেন । তিনি পীড়িত পাঠানদিগকে সেবা করিতে লাগিলেন— তাহাদিগকে পথ পানীয় ঔষধ এবং তাহাদের মৃতদেহ গাের দিতে লাগিলেন । হিন্দুরা হিন্দু সন্ন্যাসীর অনাচার দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গেল। বিন্ধন কহিতেন, “আমি সন্ন্যাসী, আমার কোনো জাত নাই। আমার জাত মানুষ। মানুষ যখন মরিতেছে তখন কিসের জাত ! ভগবানের সৃষ্ট মানুষ যখন মানুষের প্রেম চাহিতেছে তখনই বা কিসের জাত! হিন্দুরা বিন্ধনের অনাসক্ত পরহিতৈষণা দেখিয়া তাহাকে ঘূণা বা নিন্দা করিতে যেন সাহস করিল না । বিন্ধনের কাজ ভালো কি মন্দ তাহারা স্থির করিতে পারিল না । তাহাদের অসম্পূৰ্ণ শাস্ত্ৰজ্ঞান সন্দিগ্ধভাবে বলিল “ভালো নহে, কিন্তু তাহাদের হৃদয়ের ভিতরে যে মনুষ্য বাস করিতেছে সে বলিল “ভালো' ! যাহা হউক, বিন্ধন অন্য লোকের ‘ভালোমন্দো'র দিকে না। তাকাইয়া কাজ করিতে লাগিলেন । মুমূর্ষ পাঠানেরা তাহাকে দেবতা জ্ঞান করিতে লাগিল। পাঠানের ছোটাে ছোটাে ছেলেদের তিনি মড়ক হইতে দূরে রাখিবার জন্য হিন্দুদের কাছে লইয়া গেলেন । হিন্দুরা বিষম শশব্যস্ত হইয়া উঠিল, কেহ তাহাদিগকে আশ্রয় দিল না। তখন বিন্ধন একটা বড়ো পরিত্যক্ত ভাঙা মন্দিরে আশ্রয় গ্ৰহণ করিলেন । তাহার ছেলের পাল সেইখানে রাখিলেন । প্ৰাতে উঠিয়া বিন্ধন তাহার ছেলেদের জন্য ভিক্ষা করিতে বাহির হইতেন । কিন্তু ভিক্ষা কে দিবে ? দেশে শস্য কোথায় ? অনাহারে কত লোক মরিবার উপক্ৰম করিতেছে। গ্রামের মুসলমান জমিদার অনেক দূরে বাস করিতেন । বিম্বন তাহার নিকটে উপস্থিত হইলেন । বহু কষ্টে তাহাকে রাজী করিয়া তিনি ঢাকা হইতে চাউল আমদানি করিতে লাগিলেন । তিনি পীড়িতদের সেবা করিতেন এবং তঁাহার চেলারা চাউল বিতরণ করিত । মাঝে মাঝে বিন্ধন ছেলেদের সঙ্গে গিয়া খেলা করিতেন । তাহারা তাহাকে দেখিলে তুমুল কোলাহল উত্থাপন করিত— সন্ধ্যার সময় মন্দিরের পাশ দিয়া গেলে মনে হইত যেন মন্দিরে সহস্র টিয়াপাখি বাসা করিয়াছে। বিন্ধনের এসরাজের আকারের একপ্রকার যন্ত্র ছিল, যখন অত্যন্ত শ্ৰান্ত হইতেন তখন তাহাই বাজাইয়া গান করিতেন । ছেলেগুলো তঁহাকে ঘিরিয়া কেহ বা গান শুনিত, কেহ বা যন্ত্রের তার টানিত, কেহ বা র্তাহার অনুকরণে গান করিবার চেষ্টা করিয়া বিষম চীৎকার করিত । অবশেষে মড়ক মুসলমানপাড়া হইতে হিন্দুপাড়ায় আসিল । গ্রামে একপ্রকার অরাজকতা উপস্থিত হইল— চুরি-ডাকাতির শেষ নাই, যে যাহা পায় লুঠ করিয়া লয়। মুসলমানেরা দল বাধিয়া ডাকাতি আরম্ভ করিল। তাহারা পীড়িতদিগকে শয্যা হইতে টানিয়া ফেলিয়া দিয়া তক্তা মাদুর বিছানা পর্যন্ত হরণ করিয়া লইয়া যাইত। বিন্ধন প্ৰাণপণে তাহাদিগকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। বিন্ধনের কথা তাহারা অত্যন্ত মান্য করিত— লঙঘন করিতে সাহস করিত না । এইরূপে বিন্ধন যথাসাধ্য গ্রামের শান্তি রক্ষা করিতেন । একদিন সকালে বিন্ধনের এক চেলা আসিয়া তঁহাকে সংবাদ দিল যে, একটি ছেলে সঙ্গে লইয়া একজন বিদেশী গ্রামের অশথতলায় আশ্রয় লইয়াছে, তাহাকে মড়কে ধরিয়াছে, বোধ করি সে আর বাচিবে না । বিন্ধন দেখিলেন- কেদারেশ্বর অচেতন হইয়া পড়িয়া, ধ্রুব ধুলায় শুইয়া ঘুমাইয়া আছে। কেদারেশ্বরের মুমূর্ষ অবস্থা— পথকষ্টে এবং অনাহারে সে দুর্বল হইয়াছিল, এইজন্য পীড়া তাহাকে বলপূর্বক আক্রমণ করিয়াছে, কোনাে ঔষধে কিছু ফল হইল না, সেই বৃক্ষতলেই তাহার মৃত্যু হইল। ধ্ৰুবকে দেখিয়া বোধ হইল যেন বহুক্ষণ অনাহারে ক্ষুধায় কঁাদিয়া কঁাদিয়া সে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। বিশ্বন অতি সাবধানে তাহাকে কোলে তুলিয়া তাহার শিশুশালায় লইয়া গেলেন।