brዓ\\\ኃ . রবীন্দ্র-রচনাবলী অপরিপাক, উদরান্ন ততোধিক । অতএব সমাজ-সংস্কারের ন্যায় পাকযন্ত্র-সংস্কারও আমাদের আবশ্যক হইয়াছে । ' আনন্দ না থাকিলে উন্নতি হইবে কী করিয়া !! আশা উৎসাহ সঞ্চয় করিব কোথা হইতে ? অকৃতকার্যকে সিদ্ধির পথে বার বার অগ্রসর করিয়া দিবে কে ! আমাদের এই নিরানন্দের দেশে উঠিতে ইচ্ছা করে না, কাজ করিতে ইচ্ছা করে না, একবার পিডিয়া গেলেই মেরুদণ্ড ভাঙিয়া যায় । প্ৰাণ না দিলে কোনো কাজ হয় না— কিন্তু প্ৰাণ দিব কিসের পরিবর্তে ! আমাদের প্রাণ কাড়িয়া লইবে কে ! আনন্দ নাই, আনন্দ নাই- দেশে আনন্দ নাই, জাতির হৃদয়ে আনন্দ নাই । কেমন করিয়া থাকিবে ! আমাদের এই স্বল্পায়ু ক্ষুদ্র শীর্ণ দেহ, অম্লশূলে বিদ্ধ, ম্যালেরিয়ায় জীৰ্ণ, রোগের অবধি নাই— বিশ্বব্যাপিনী আনন্দসুধার অনন্ত প্রস্রবণধারা আমরা যথেষ্ট পরিমাণে ধারণ করিয়া রাখিতে পারি না— এইজন্য নিদ্রা আর ভাঙে না, একবার শ্ৰান্ত হইয়া পড়িলে শ্ৰান্তি আর দূর হয় না, একবার কার্য ভাঙিয়া গেলে কাৰ্য আর গঠিত হয় না, একবার অবসাদ উপস্থিত হইলে তাহা ক্রমাগতই ঘনীভূত হইতে থাকে । অতএব কেবল মাতিয়া উঠিলেই হইবে না ; সেই মত্ততা ধারণ করিয়া রাখিবার, সেই মত্ততা সমস্ত ‘জাতির শিরার মধ্যে সঞ্চারিত করিয়া দিবার ক্ষমতা সঞ্চয় করা চাই । একটি স্থায়ী আনন্দের ভাব সমস্ত জাতির হৃদয়ে দৃঢ় বদ্ধমূল হওয়া চাই । এমন এক প্রবল উত্তেজনাশক্তি আমাদের জাতিহাদয়ের কেন্দ্ৰস্থলে অহরহ দণ্ডায়মান থাকে যাহার আনন্দ-উচ্ছাসবেগে আমাদের জীবনের প্রবাহ সহস্র ধারায় জগতের সহস্ৰ দিকে প্রবাহিত হইতে পারে ! কোথায় বা সে শক্তি ! কোথায় বা তাহার দাড়াইবার স্থান ! সে শক্তির পদভারে আমাদের এই জীৰ্ণ দেহ বিদীর্ণ হইয়া ধূলিসাৎ হইয়া যায় । আমি তো ভাই, ভাবিয়া রাখিয়াছি, যে দেশের আবহাওয়ায় বেশি মশা জন্মায় সেখানে বড়ো জাতি জন্মিতে পারে না । এই আমাদের জলা-জমি জঙ্গল, এই কোমল মৃত্তিকার মধ্যে, কর্মানুষ্ঠানতৎপর প্রবল সভ্যতার স্রোত আসিয়া আমাদের কাননবেষ্টিত প্রচ্ছন্ন নিভৃত ক্ষুদ্র কুটিরগুলি কেবল ভাঙিয়া দিতেছে মাত্র । আকাঙক্ষা আনিয়া দিতেছে, কিন্তু উপায় নাই ; কাজ বাড়াইয়া দিতেছে, কিন্তু শরীর নাই ; অসন্তোষ আনিয়া দিতেছে, কিন্তু উদ্যম নাই । আমাদের যে স্বস্তি ছিল তাহা ভাসাইয়া দিতেছে, তাহার পরিবর্তে যে সুখে মরীচিকা রচনা করিতেছে তাহাও আমাদের দুপ্তপ্রাপ্য । কাজ করিয়া প্রকৃত সিদ্ধি নাই, কেবল অহনিশি শ্রান্তিই সার । আমার মনে হয় তার চেয়ে আমরা ছিলাম ভালোআমাদের সেই স্নিগ্ধ কাননচ্ছায়ায়, পল্লবের মর্মর শব্দে, নদীর কলস্বরে, সুখের কুটিরে-- স্নেহশীল পিতামাতা, পতিপ্ৰাণা স্ত্রী, স্বজনবৎসল পুত্রকন্যা, পরিবারপ্রতিম পরিচিত প্রতিবেশীদিগকে লইয়া, যে নিরুপদ্রব নীড়টুকু রচনা করিয়াছিলাম, সে ছিলাম ভালো । যুরোপীয় বিরাট সভ্যতার পাষাণ-উপকরণসকল আমরা কোথায় পাইব ! কোথায় সে বিপুল বল, সে শ্রান্তিমোচন জলবায়ু, সে ধুরন্ধর প্রশস্ত ললাট ! অবিশ্রাম কর্মানুষ্ঠান, বাধাবিয়ের সহিত অবিশ্রাম যুদ্ধ, নূতন নূতন পথের অনুসন্ধানে অবিশ্রাম ধাবন, অসন্তোষানলে অবিশ্রাম দহন—- সে আমাদের এই প্রখর রৌদ্রতপ্ত আদ্ৰসিক্ত দেশে জীৰ্ণশীর্ণ দুর্বল দেহে পারিব কেন ? কেবল আমাদের শ্যামল শীতল তৃণনিবাস পরিত্যাগ করিয়া আমরা পতঙ্গের মতো উগ্র সভ্যতানলে দগ্ধ হইয়া মরিব মাত্ৰ । বালকেরা শুনিবে এবং বৃদ্ধের বলিবে- এইজন্য তোমাদের কাছে সংক্ষেপ-চিঠি প্রত্যাশা করি, কিন্তু নিজে বড়ো চিঠি লিখি । অর্বাচীনদের কথা ধৈর্য ধরিয়া বেশিক্ষণ শুনিতে পারি না, কিন্তু নিজের কথা বলিয়া তৃপ্তি হয় না— অতএব ‘নিজে যেরূপ ব্যবহার প্রত্যাশা কর অন্যের প্রতি সেইরূপ আচরণ করিবে’ বাইবেলের এই উপদেশ –অনুসারে আমার সহিত কাজ করিয়ো না, আগে হইতে সতর্ক করিয়া लेिब्लोभा | আশীৰ্বাদক শ্ৰীষষ্ঠীচরণ দেবাশমণঃ
