পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পঞ্চভুত ՏՏ Գ উঠিতেছে। সেইরূপ আমাদের চেতনা প্রতিদিন যাহা-কিছু আনিতেছে, ফেলিতেছে, সেই সমস্ত ক্রমে ংস্কার স্মৃতি অভ্যাস -আকারে একটি বৃহৎ গোপন আধারে অচেতন ভাবে সঞ্চিত হইয়া উঠিতেছে। : তাহাই আমাদের জীবনের ও চরিত্রের স্থায়ী ভিত্তি। সম্পূর্ণ তলাইয়া তাহার সমস্ত স্তরপর্যায় কেহ আবিষ্কার করিতে পারে না। উপর শুইতে যতটা দৃশ্যমান হইয়া উঠে, অথবা আকস্মিক ভূমিকম্পবেগে যে নিগুঢ় অংশ উর্ধের্ব উৎক্ষিপ্ত হয় তাহাই আমরা দেখিতে পাই। এই মহাদেশেই শস্য পুষ্প ফল, সৌন্দর্য ও জীবন, অতি সহজে উদ্ভিন্ন হইয়া উঠে । ইহা দৃশ্যত স্থির ও নিক্রিয়, কিন্তু ইহার ভিতরে একটি অনায়াসনৈপুণ্য, একটি গোপন জীবনীশক্তি নিগৃঢ়ভাবে কাজ করিতেছে। সমুদ্র কেবল ফুলিতেছে এবং দুলিতেছে, বাণিজ্যতরী ভাসাইতেছে এবং ডুবাইতেছে, অনেক আহরণ এবং সংহরণ করিতেছে, তাহার বলের সীমা নাই, কিন্তু তাহার মধ্যে জীবনীশক্তি ধারণীশক্তি নাই— সে কিছুই জন্ম দিতে ও পালন করিতে পারে না । রূপকে যদি কাহারও আপত্তি না থাকে। তবে আমি বলি আমাদের এই চঞ্চল বহিরাংশ পুরুষ, এবং এই বৃহৎ গোপন অচেতন অন্তরংশ নারী । এই স্থিতি এবং গতি সমাজে স্ত্রী ও পুরুষের মধ্যে ভাগ হইয়া গিয়াছে। সমাজের সমস্ত আহরণ, উপার্জন, জ্ঞান ও শিক্ষা স্ত্রীলোকের মধ্যে গিয়া নিশ্চল স্থিতি লাভ করিতেছে । এইজন্য তাহার এমন সংস্কারগুলি এমন দৃঢ় ও পুরাতন, তাহার সকল কর্তব্য এমন চিরাভ্যস্ত সহজসাধ্যের মতো হইয়া সেই সমুদয় চঞ্চল প্রাচীন পরিবর্তনের ইতিহাস স্ত্রীলোকের মধ্যে স্তরে স্তরে নিত্য ভাবে সঞ্চিত হইতেছে । পুরুষ আংশিক, বিচ্ছিন্ন, সামঞ্জস্যবিহীন । আর স্ত্রীলোক এমন একটি সংগীত যাহা সমে আসিয়া সুন্দর সুগোল ভাবে সম্পূর্ণ হইতেছে ; তাহাতে উত্তরোত্তর যতই পদ সংযোগ ও নব নব তান যোজন: করো-না কেন, সেই সমটি আসিয়া সমস্তটিকে একটি সুগোল সম্পূর্ণ গণ্ডি দিয়া ঘিরিয়া লয়। মাঝখানে একটি স্থির কেন্দ্র অবলম্বন করিয়া আবর্ত আপনার পরিধিবিস্তার করে, সেইজন্য হাতের কাছে যাহা আছে তাহা সে এমন সুনিপুণ সুন্দর -ভাবে টানিয়া আপনার করিয়া লইতে পারে। এই-যে কেন্দ্রটি ইহা বুদ্ধি নহে, ইহা একটি সহজ আকর্ষণশক্তি । ইহা একটি ঐক্যবিন্দু । মনঃপদার্থটি যেখানে আসিয়া উকি মারেন সেখানে এই সুন্দর ঐক্য শতধা বিক্ষিপ্ত হইয়া যায় । ব্যোম অধীরের মতো হইয়া হঠাৎ আরম্ভ করিয়া দিল— তুমি যাহাকে ঐক্য বলিতেছ। আমি তাহাকে আত্মা বলি ; তাহার ধর্মই এই, সে পাচটা বস্তুকে আপনার চারি দিকে টানিয়া আনিয়া একটা গঠন দিয়া গড়িয়া তোলে ; আর যাহাকে মন বলিতেছ। সে পাচটা বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট হইয়া আপনাকে এবং তাহাদিগকে ভাঙিয়া ভাঙিয়া ফেলে । সেইজন্য আত্মযোগের প্রধান সোপান হইতেছে মনটাকে অবরুদ্ধ করা । ইংরাজের সহিত সমীর মনের যে তুলনা করিয়াছেন। এখানেও তাহা খাটে । ইংরাজ সকল জিনিসকেই অগ্রসর হইয়া, তাড়াইয়া, খেদাইয়া ধরে । তাহার “আশাবধিং কো গতঃ), শুনিয়াছি সূর্যদেবও নহেন— তিনি তাহার রাজ্যে উদয় হইয়া এ পর্যন্ত অস্ত হইতে পারিলেন না। আর আমরা আত্মার ন্যায় কেন্দ্ৰগত হইয়া আছি ; কিছু হরণ করিতে চাহি না, চতুর্দিকে যাহা আছে তাহাকে ঘনিষ্ঠ ভাবে আকৃষ্ট করিয়া গঠন করিয়া তুলিতে চাই। এইজন্য আমাদের সমাজের মধ্যে, গৃহের মধ্যে, ব্যক্তিগত জীবনযাত্রার মধ্যে, এমন একটা রচনার নিবিড়তা দেখিতে পাওয়া যায় । আহরণ করে মন, আর সৃজন করে আত্মা । যোগের সকল তথ্য জানি না, কিন্তু শোনা যায় যোগবলে যোগীরা সৃষ্টি করিতে পারিতেন । প্রতিভার সৃষ্টিও সেইরূপ । কবিরা সহজ ক্ষমতাবলে মনটাকে নিরস্ত করিয়া দিয়া অর্ধ-অচেতনভাবে যেন একটা আত্মার আকর্ষণে ভাব রস দৃশ্য বর্ণ ধ্বনি কেমন করিয়া সঞ্চিত করিয়া, পুঞ্জিত করিয়া,