পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SVO রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী দীপ্তি বিশেষ একটু বিরক্ত হইয়া কহিল— তোমার গ্ৰীক প্রস্তরমূর্তির কথা ছাড়িয়া দাও। ও সম্বন্ধে অনেক কথা শুনিয়াছি এবং বাচিয়া থাকিলে আরো অনেক কথা শুনিতে হইবে । ভালো জিনিসের দোষ এই যে, তাহাকে সর্বদাই পৃথিবীর চোখের সামনে থাকিতে হয়, সকলেই তাহার সম্বন্ধে কথা কহে, তাহার আর পর্দা নাই, আৰু নাই ; তাহাকে আর কাহারও আবিষ্কার করিতে হয় না, বুঝিতে হয় না, ভালো করিয়া চোখ মেলিয়া তাহার প্রতি তাকাইতেও হয় না, কেবল তাহার সম্বন্ধে বাধি গৎ শুনিতে এবং বলিতে হয়। সূর্যের যেমন মাঝে মাঝে মেঘগ্রস্ত থাকা উচিত, নতুবা মেঘমুক্ত সূর্যের গৌরব বুঝা যায় না, আমার বোধ হয়। পৃথিবীর বড়ো বড়ো খ্যাতির উপরে মাঝে মাঝে সেইরূপ অবহেলার আড়াল পড়া উচিত— মাঝে মাঝে গ্ৰীক মূর্তির নিন্দা করা ফেশান হওয়া ভালো, মাঝে মাঝে সর্বলোকের নিকট প্রমাণ হওয়া উচিত যে, কালিদাস অপেক্ষা চাণক্য বড়ো কবি। নতুবা আর সহ্য হয় না । যাহা হউক, ওটা একটা অপ্রাসঙ্গিক কথা । আমার বক্তব্য এই যে, অনেক সময়ে ভাবের দারিদ্র্যকে, আচারের বর্বরতাকে, সরলতা বলিয়া ভ্ৰম হয়- অনেক সময়ে প্রকাশক্ষমতার অভাবকে ভাবাধিক্যের পরিচয় বলিয়া কল্পনা করা হয়- সে কথাটাও মনে রাখা কর্তব্য । আমি কহিলাম- কলাবিদ্যায় সরলতা উচ্চ অঙ্গের মানসিক উন্নতির সহচর । বর্বরতা সরলতা নহে । বর্বরতার আড়ম্বর-আয়োজন অত্যন্ত বেশি । সভ্যতা অপেক্ষাকৃত নিরলংকার । অধিক অলংকার আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, কিন্তু মনকে প্রতিহত করিয়া দেয়। আমাদের বাংলা ভাষায়, কি খবরের কাগজে কি উচ্চশ্রেণীর সাহিত্যে, সরলতা এবং অপ্ৰমত্ততার অভাব দেখা যায়- সকলেই অধিক করিয়া, চীৎকার করিয়া এবং ভঙ্গিমা করিয়া বলিতে ভালোবাসে ; বিনা আড়ম্বরে সত্য কথাটি পরিষ্কার করিয়া বলিতে কাহারও প্রবৃত্তি হয় না। কারণ, এখনো আমাদের মধ্যে একটা আদিম বর্বরতা আছে ; সত্য প্ৰাঞ্জল বেশে আসিলে তাহার গভীরতা এবং অসামান্যতা আমরা দেখিতে পাই না, ভাবের সৌন্দর্য কৃত্ৰিম ভূষণে এবং সর্বপ্রকার আতিশয্যে ভারাক্রান্ত হইয়া না আসিলে আমাদের নিকট তাহার মর্যাদা নষ্ট হয় । সমীর কহিল- সংযম ভদ্রতার একটি প্রধান লক্ষণ । ভদ্রলোকেরা কোনোপ্রকার গায়ে-পড়া আতিশয্য-দ্বারা আপন অস্তিত্ব উৎকট ভাবে প্রচার করে না ; বিনয় এবং সংযমের দ্বারা তাহারা আপন মর্যাদা রক্ষা করিয়া থাকে। অনেক সময় সাধারণ লোকের নিকট সংযত সুসমাহিত ভদ্রতার অপেক্ষা আড়ম্বর এবং আতিশয্যের ভঙ্গিমা অধিকতর আকর্ষণজনক হয়, কিন্তু সেটা ভদ্রতার দুর্ভাগ্য নহে, সে সাধারণের ভাগ্যদোষ । সাহিত্যে সংযম এবং আচারব্যবহারে সংযম উন্নতির লক্ষণ— আতিশয্যের দ্বারা দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টাই বর্বরতা । আমি কহিলাম- এক-আধটা ইংরাজি কথা মাপ করিতে হইবে । যেমন ভদ্রলোকের মধ্যে তেমনি ভদ্র সাহিত্যেও ম্যানার আছে, কিন্তু ম্যানারিজম নাই। ভালো সাহিত্যের বিশেষ একটি আকৃতিপ্ৰকৃতি আছে সন্দেহ নাই ; কিন্তু তাহার এমন একটি পরিমিত সুষমা যে, আকৃতিপ্রকৃতির বিশেষত্বটাই বিশেষ করিয়া চােখে পড়ে না। তাহার মধ্যে একটা ভাব থাকে, একটা গৃঢ় প্রভাব থাকে, কিন্তু কোনাে অপূর্ব ভঙ্গিমা থাকে না । তরঙ্গভঙ্গের অভাবে অনেক সময়ে পরিপূর্ণতাও লোকের দৃষ্টি এড়াইয়া যায়, আবার পরিপূর্ণতার অভাবে অনেক সময়ে তরঙ্গভঙ্গও লোককে বিচলিত করে, কিন্তু তাই বলিয়া এ ভ্রম যেন কাহারও না হয় যে, পরিপূর্ণতার প্রাঞ্জলতাই সহজ এবং অগভীরতার ভঙ্গিমাই দুরূহ। স্রোতস্বিনীর দিকে ফিরিয়া কহিলাম— উচ্চশ্রেণীর সরল সাহিত্য বুঝা অনেক সময় এইজন্য কঠিন যে, মন তাহাকে বুঝিয়া লয়, কিন্তু সে আপনাকে বুঝাইতে থাকে না । দীপ্তি কহিল- নমস্কার করি ! আজি আমাদের যথেষ্ট শিক্ষা হইয়াছে । আর কখনো উচ্চ অঙ্গের পণ্ডিতদিগের নিকট উচ্চ অঙ্গের সাহিত্য সম্বন্ধে মত ব্যক্ত করিয়া বর্বরতা প্ৰকাশ করিব না । স্রোতস্বিনী সেই ইংরাজ কবির নাম করিয়া কহিল- তোমরা যতই তর্ক কর এবং যতই গালি দাও, সে কবির কবিতা আমার কিছুতেই ভালো লাগে না । ” CbJ. Soo S