পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মানুষের ধর্ম 8XX না বলে নিবৃত্ত হলেই মানুষ পবিত্র হতে পারে— সেখানে এই বলাতেই মানুষ আপন বুদ্ধিতে স্বীকার করে বিশ্বমনের প্রজ্ঞাকে। তং হ দেবম্ আত্মবুদ্ধিপ্রকাশম্— সেই দেবতাকে আমাদের আত্মায় জানি যিনি আত্মবুদ্ধিপ্রকাশক। আমার মন আর বিশ্বমন একই, এই কথাই সত্যসাধনার মূলে, আর ভাষান্তরে এই কথাই সোহহম্। একদিন ব্রাহ্মণ রামানন্দ তার শিষ্যদের কাছ থেকে চলে গিয়ে আলিঙ্গন করলেন নাভী চণ্ডালকে, মুসলমান জোল কবীরকে, রবিদাস চামারকে। সেদিনকার সমাজ তাকে জাতিচু্যত করলে। কিন্তু, তিনি একলাই সেদিন সকলের চেয়ে বড়ো জাতিতে উঠেছিলেন যে জাতি নিখিল মাহুষের। সেদিন ব্রাহ্মণমণ্ডলীর ধিক্কারের মাঝখানে এক দাড়িয়ে রামানন্দই বলেছিলেন লোহহম্ ; সেই সত্যের শক্তিতেই তিনি পার হয়ে গিয়েছিলেন সেই ক্ষুদ্র সংস্কারগত ঘৃণাকে যা নিষ্ঠুর হয়ে মানুষে মানুষে ভেদ ঘটিয়ে সমাজস্থিতির নামে সমাজধর্মের মূলে আঘাত করে। একদিন যিশুখৃস্ট বলেছিলেন, “সোহহম। আমি আর আমার পরমপিতা একই।” কেননা, তার যে প্রতি, যে কল্যাণবুদ্ধি সকল মানুষের প্রতি সমান প্রসারিত সেই প্রীতির আলোকেই আপন অহংসীমাকে ছাড়িয়ে পরমমানবের সঙ্গে তিনি আপন অভেদ দেখেছিলেন । বুদ্ধদেব উপদেশ দিলেন, সমস্ত জগতের প্রতি বাধাশূন্ত হিংসাশূন্ত শক্রতাশূন্ত মানসে অপরিমাণ মৈত্রী পোষণ করবে। দাড়াতে বসতে চলতে শুতে, যাবৎ নিদ্রিত না হবে, এই মৈত্রীস্মৃতিতে অধিষ্ঠিত থাকবে— একেই বলে ব্রহ্মবিহার। سجي এতবড়ো উপদেশ মানুষকেই দেওয়া চলে। কেননা, মাহুষের মধ্যে গভীর হয়ে আছে সোহহংতত্ত্ব। সে কথা বুদ্ধদেব নিজের মধ্য থেকেই জেনেছেন, তাই বলেছেন, অপরিমাণ প্রেমেই আপনার অস্তরের অপরিমেয় সত্যকে মানুষ প্রকাশ করে। অথর্ববেদ বলেন, তস্মাদ বৈ বিদ্বান পুরুষমিদং ব্রহ্মেতি মন্ততে— যিনি বিদ্বান তিনি মানুষকে তার প্রত্যক্ষের অতীত বৃহৎ বলেই জানেন। সেইজন্যে তিনি তার কাছে প্রত্যাশা করতে পারেন দুঃসাধ্য কর্মকে, অপরিমিত ত্যাগকে। যে পুরুষে ব্রহ্ম বিদুস্তে বিছঃ পরমেষ্টিনম্— যারা ভূমাকে জানেন মানুষে তারা জানেন পরম দেবতাকেই। সেই মানবদেবতাকে মহিষের মধ্যে জেনেছিলেন বলেই বুদ্ধদেব উপদেশ দিতে পেরেছিলেন— মাতা যথা নিয়ং পুত্তং আয়ুস এক পুত্তমম্বরকৃখে, * এবম্পি সৰ্ব্বভূতেষু মানসম্ভাবরে অপরিমাণং। , মা যেমন আপন আয়ু ক্ষয় করেই নিজের একমাত্র পুত্রকে রক্ষা করে তেমনি সকল প্রাণীর প্রতি মনে অপরিমাণ দয়াভাব জন্মাবে।