পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষড়্‌বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পসল্প එළුකු জমিদারের সামান্ত পাইক। এমন-কি, তার নামটাই ভুলে গেছি। ধরে নেওয়া যাক স্বজনলাল মিশির। একটু নামের গোলমাল হলে ইতিহাসের কোনো পণ্ডিত তা নিয়ে কোনো তর্ক করবে না । সেদিন ছিল যাকে বলে জমিদারি সেরেস্তার ‘পুণ্যাহ’, খাজনা-আদায়ের প্রথম দিন । কাজটা নিতান্তই বিষয়-কাজ । কিন্তু, জমিদারি মহলে সেটা হয়ে উঠেছে একটা পার্বণ। সবাই খুশি– যে খাজনা দেয় সেও, আর যে খাজনা বাক্সতে ভবৃতি করে সেও । এর মধ্যে হিসেব মিলিয়ে দেখবার গন্ধ ছিল না । যে যা দিতে পারে তাই দেয়, প্রাপ্য নিয়ে কোনো তকরার করা হয় না। খুব ধুমধাম, পাড়াগেয়ে সানাই অত্যন্ত বেম্বরে আকাশ মাতিয়ে তোলে। নতুন কাপড় প’রে প্রজারা কাছারিতে পেলাম দিতে আসে । সেই পুণ্যাহের দিনে ঢাক ঢোল সানাইয়ের শব্দে জেগে উঠে ম্যানেজারবাবু ঠিক করলেন, তিনি স্নান করবেন দুধে । চারি দিকে সমারোহ দেখে হঠাৎ তার মনে হল, তিনি তো সামান্ত লোক নন । সামান্ত জলে তার অভিষেক কী করে হবে । ঘড়া ঘড়া দুধ এল গোয়ালা প্রজাদের কাছ থেকে ৷ হল তার স্নান । নাম বেরিয়ে গেল চারি দিকে ; সেদিন তিনি সন্ধ্যাবেলায় খুশিমনে বাসার রোয়াকে ব’লে গুড়গুড়ি টানছেন, এমন সময় মিশির সর্দার, ব্রাহ্মণের ছেলে লাঠিখেলা নিয়ে খুব নাম করেছে, বললে, হুজুর আপনার নিমক তো খেয়েছি অনেককাল, কিন্তু অনেকদিন বলে আছি, আমাকে তো কাজে লাগালেন না । যদি কিছু করবার থাকে তো হুকুম করুন । ম্যানেজার গুড়গুড়ি টানতে লাগলেন। মনে পড়ে গেল একটা কাজের কথা । জলিম মণ্ডল চর মহলের প্রজা, তার খেত ছিল পাশের জমিদারের সীমানা-ঘেঁষা । ফসল জন্মালেই প্রতিবেশী জমিদার লোকজন নিয়ে প্রজাকে আটকাত । দায়ে পড়ে জলিমের দুই জমিদারেরই খাতায় আর দু জায়গাতেই খাজনা দিয়ে ফসল সামলাতে হত। যে ম্যানেজার দুধে স্নান করেন এটা তার ভালো লাগে নি । এ বছরের জলিধানের ফসল কাটবার সময় আসছে— এটা চরের বিশেষ ফসল। চরের জমির জল নেমে গেলেই কৃষাণ পলিমাটিতে বীজ ছিটিয়ে দেয়, শ্রাবণ ভাদ্র মাসে ফসল গোলায় তোলে। এ বছরটা ছিল ভালো ; ধানের শিষে সমস্ত মাঠ হি হি করছে । এবারকার ফসল বেদখল হলে ভারি লোকসান । ম্যানেজার বললেন, সঙ্গার, একটা কাজ আছে । জলিমের জমিতে তোমাকে ধান আগলাতে হবে। একা তোমারই উপরে ভার। দেখব কেমন মরদ তুমি ।