পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষড়্‌বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বাংলাভাষা-পরিচয় \צ"לס তখন তাকে ইশারায় আনা যায় না, বর্ণনায় পাওয়া যায় না, কেবল ভাষার নৈপুণ্যে যত দূর সম্ভব নানা ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেওয়া যেতে পারে। ভাষা হৃদয়বোধের গভীরে নিয়ে যেতে পেরেছে বলেই মানুষের হৃদয়াবেগের উপলব্ধি উৎকৰ্ষ লাভ করেছে । সংস্কৃতিমানদের বোধশক্তির রূঢ়তা যায় ক্ষয় হয়ে, তাদের অস্থভূতির মধ্যে স্বল্প স্বকুমার ভাবের প্রবেশ ঘটে সহজে । গোয়ার হৃদয় হচ্ছে অশিক্ষিত হৃদয় । অবশু স্বভাবদোষে রুচি ও অনুভূতির পরুবতা যাদের মজ্জাগত তাদের আশা ছেড়ে দিতে হয়। জ্ঞানের শক্তি নিয়েও এ কথা থাটে। স্বাভাবিক মূঢ়ত যাদের দুর্ভেদ্য, জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চায় তাদের বুদ্ধিকে বেশি দূর পর্যন্ত সার্থকতা দিতে পারে না । মানুষের বুদ্ধিসাধনার ভাষা আপন পূর্ণতা দেখিয়েছে দর্শনে বিজ্ঞানে । হৃদয়বৃত্তির চূড়ান্ত প্রকাশ কাব্যে । দুইয়ের ভাষায় অনেক তফাত । জ্ঞানের ভাষা যত দূর সম্ভব পরিষ্কার হওয়া চাই ; তাতে ঠিক কথাটার ঠিক মানে থাকা দরকার, সাজসজ্জার বাহুল্যে সে যেন আচ্ছন্ন না হয় । কিন্তু ভাবের ভাষা কিছু যদি অস্পষ্ট থাকে, যদি সোজা ক’রে না বলা হয়, যদি তাতে অলংকার থাকে উপযুক্তমত, তাতেই কাজ দেয় বেশি । জ্ঞানের ভাষায় চাই স্পষ্ট অর্থ ; ভাবের ভাষায় চাই ইশারা, হয়তো অর্থ বাকী ক'রে দিয়ে । ভালো লাগা বোঝাতে কবি বললেন, “পাষাণ মিলায়ে যায় গায়ের বাতাসে’ । বললেন, ‘ঢল ঢল কাচা অঙ্গের লাবণি অবনি বহিয়া যায়’ । এখানে কথাগুলোর ঠিক মানে নিলে পাগলামি হয়ে দাড়াবে। কথাগুলো যদি বিজ্ঞানের বইয়ে থাকত তা হলে বুঝতুম, বিজ্ঞানী নতুন আবিষ্কার করেছেন এমন একটি দৈহিক হাওয়া যার রাসায়নিক ক্রিয়ায় পাথর কঠিন থাকতে পারে না, গ্যাস রূপে হয় অদৃপ্ত । কিংবা কোনো মাচুষের শরীরে এমন একটি রশ্মি পাওয়া গেছে যার নাম দেওয়া হয়েছে লাবাণ, পৃথিবীর টানে যার বিকিরণ মাটির উপর দিয়ে ছড়িয়ে যেতে থাকে । শব্দের অর্থকে একান্ত বিশ্বাস করলে এইরকম একটা ব্যাখ্যা ছাড়া উপায় থাকে না । কিন্তু এ-ষে প্রাকৃত ঘটনার কথা নয়, এ-যে মনে-ছয়-যেন'র কথা । শব্দ তৈরি হয়েছে ঠিকটা-কী জানাবার জন্তে ; সেইজন্তে ঠিক-যেন-কী বলতে গেলে তার অর্থকে বাড়াতে হয়, বাকাতে হয়। ঠিক-যেন-কীর ভাষা অভিধানে বেঁধে দেওয়া নেই, তাই সাধারণ ভাষা দিয়েই কবিকে কৌশলে কাজ চালাতে হয়। তাকেই বলা যায় কবিত্ব । বস্তুত কবিত্ব এত বড়ো জায়গা পেয়েছে তার প্রধান কারণ, ভাষার শব্দ কেবল আপন সাদা অর্থ দিয়ে সব ভাব প্রকাশ করতে পারে না । তাই কবি লাবণ্য শব্দের যথার্থ সংজ্ঞা ত্যাগ ক’রে বানিয়ে বললেন, যেন লাবণ্য একটা ঝরনা, শরীর থেকে ঝরে পড়ে মাটিতে । কথার