পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষড়্‌বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পথের সঞ্চয় । | M. 8&6. লক্ষ্মীর ক্রোড়ে লালিত ক্রোড়পতি, যাহারা টাকার জোরে চিরকাল নিজেকে অন্তসকলের চেয়ে বেশি বলিয়াই মনে করিয়া আলিয়াছে, ভোগে বাহারা বাধা পায় নাই । এবং রোগে বিপদে যাহারা আপনাকে বাচাইবার স্থযোগ অন্ত-সকলের চেয়ে সহজে লাভ করিয়া আলিয়াছে, তাহারা ইচ্ছা করিয়া দুর্বলকে অক্ষমকে বাচিবার পথ ছাড়িয়া দিয়া মৃত্যুকে বরণ করিয়াছে। এরূপ ক্রোড়পতি এ জাহাজে কেবল এক-আধজন মাত্র ছিল না । আকস্মিক উৎপাতে মাছবের আদিম প্রবৃত্তিই সভ্য সমাজের সংযম ছিন্ন করিয়া দেখা দিতে চায়, ভাবিবার সময় হাতে পাইলে মাছুষ আত্মসম্বরণ করিতে পারে। টাইটানিক জাহাজে অন্ধকার রাত্রে কেহ বা নিত্রার মধ্যে হঠাৎ জাগিয়া, কেহ বা আমোদ প্রমোদের মধ্য হইতে হঠাৎ বাহির হইয়া, সম্মুখে অপঘাতসত্যুর কালো মূর্তি দেখিতে পাইল । তখন যদি ইহাই দেখা যায়, মানুষ পাগলের মতো হইয়া অক্ষমকে ঠেলিয়া ফেলিয়া আপনাকে বাচাইবার চেষ্টা করিতেছে না, তবে বুঝিতে হইবে, এই বীরত্ব আকস্মিক নয়, ব্যক্তিগত নয় ; সমস্ত জাতির বহুদিনের তপস্তার সহিত আধ্যাত্মিক শক্তি ভীষণ পরীক্ষায় মৃত্যুর উপরে জয়লাভ করিল। এই জাহাজডুবিতে একসঙ্গে নিবিড় করিয়া যে শক্তিকে দেখিয়াছি, যুরোপে সেই শক্তিকেই কি নানা দিকে নানা আকারে দেখি নাই। দেশহিতের ও লোকহিতের জন্ত সর্বস্বত্যাগ ও প্রাণবিসর্জনের দৃষ্টান্ত কি সেখানে প্রত্যহই হাজার হাজার দেখা যায় না। সেই অজস্রসঞ্চিত পুষ্ট্ৰীভূত ত্যাগের দ্বারাই কি যুরোপীয় সভ্যতা প্রবাল-দ্বীপের মতো মাথা তুলিয়া উঠে নাই । কোনো সমাজে যথার্থ কোনো উন্নতিই হইতে পারে না যাহার ভিত্তি দুঃখের উপর প্রতিষ্ঠিত নহে। এই দুঃখকে তাহারাই বরণ করিতে পারে না যাহারা মেটেরিয়ালিস্ট, যাহারা জড়বস্তুর দাস। বস্তুতেই যাহাঁদের চরম আনন্দ, বস্তুকে তাহারা ত্যাগ করিবে কেন । কল্যাণকে তাহারা আপনার প্রাণের চেয়ে কেন বড়ো করিয়া স্বীকার করিবে । শাস্ত্ৰবিহিত যে পুণ্যকে মানুষ পারলৌকিক বিষয়সম্পত্তির মতোই জানে সেই স্বার্থপর পুণ্যের জন্তও সে দুঃখস্বীকার করিতে পারে— কিন্তু ৰে পুণ্য শাস্ত্রৰিধির সামগ্ৰী নহে, যাহা তীর্থযাত্রার দুঃখ নহে, বাহা শুভনক্ষত্ৰৰোগের দান নছে, যাহা হৃদয়ের স্বাধীন প্ররোচনা, সেই দুঃখ, সেই মৃত্যুকে কি কখনো কোনো বস্তু-উপাসক গ্রহণ করিতে পারে । 驗 যুরোপে দেশের জন্ম, মানুষের জন্ত, জ্ঞানের জঙ্ক, প্রেমের জন্ত, হৃদয়ের স্বাধীন আবেগে, সেই দুখকে, সেই মৃত্যুকে আমরা প্রতিনিই বরণ করিতে দেখিয়াছি।