পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষড়্‌বিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ఆSఆ রবীন্দ্র-রচনাবলী লিখতেন শুনিয়ে যেতেন, শোনবার লোক জমত র্তার চার দিকে । আমরা বাড়িম্বন্ধ সবাই মেতে গিয়েছিলুম এই কাব্যের রসে । পড়ার মাঝে মাঝে উচ্চহালি উঠত উথলিয়ে । তার হালি ছিল আকাশ-ভরা ; সেই হাসির কোকের মাথায় কেউ যদি হাতের কাছে থাকত তাকে চাপড়িয়ে অস্থির করে তুলতেন । জোড়াসাকোর বাড়ির প্রাণের একটি ঝরনাতলা ছিল এই দক্ষিণের বারান্দা, শুকিয়ে গেল এর স্রোত, বড়দাদা চলে গেলেন শাস্তিনিকেতন আশ্রমে । আমার কেবল মাঝে মাঝে মনে পড়ে, ঐ বারান্দার সামনেকার বাগানে মন-কেমন-করা শরতের রোদ্ধর ছড়িয়ে পড়েছে, আমি নতুন গান তৈরি করে গাচ্ছি ‘আজি শরততপনে প্রভাতস্বপনে কী জানি পরান কী যে চায়' । আর মনে আসে একটি তপ্ত দিনের বঁা! বঁ। দুই প্রহরের গান “হেলাফেলা সারাবেল এ কী খেলা আপন-সনে । বড়দাদার আর-একটি অভ্যাস ছিল চোখে পড়বার মতো, সে তার সাতার কাটা । পুকুরে নেমে কিছু না হবে তো পঞ্চাশ বার এপার-ওপার করতেন। পেনেটির বাগানে যখন ছিলেন তখন গঙ্গা পেরিয়ে চলে যেতেন অনেক দূর পর্যন্ত। তার দেখাদেখি সাতার আমরাও শিখেছি ছেলেবেলা থেকে । শেখা শুরু করেছিলুম নিজে নিজেই। পায়জামা ভিজিয়ে নিয়ে টেনে টেনে ভরে তুলতুম বাতাসে । জলে নামলেই সেটা কোমরের চার দিকে হাওয়ার কোমরবন্দর মতো ফুলে উঠত । তার পরে আর ডোববার জে থাকত না। বড়োবয়সে যখন শিলাইদহের চরে থাকতুম তখন একবার সাতার দিয়ে পদ্ম পেরিয়েছিলুম। কথাটা শুনতে যতটা তাক-লাগানো আসলে ততটা নয়। মাঝে মাঝে চর-পড়া সেই পদ্মার টান ছিল না তাকে সমীহ করবার মতো ; তবু ভাঙার লোকের কাছে ভয়-লাগানো গল্পটা শোনাবার মতো বটে, শুনিয়েওছি অনেকবার । ছেলেবেলায় যখন গিয়েছি ভ্যালহৌসি পাহাড়ে, পিতৃদেব আমাকে এক-একা ঘুরে বেড়াতে কখনো মানা করেন নি। পায়ে-চলা রাস্তায় আমি ফলাওয়ালা লাঠি হাতে এক পাহাড় থেকে আর-এক পাহাড়ে উঠে যে তুষ । তার সকলের চেয়ে মজা ছিল মনে মনে ভয় বানিয়ে তোলা। একদিন ওৎরাই পথে যেতে যেতে পা পড়েছিল গাছের তলায় রাশ-করা শুকনো পাতার উপর। পা একটু হড়কে যেতেই লাঠি দিয়ে ঠেকিয়ে দিলুম।.কিন্তু না ঠেকাতেও তো পারতুম। ঢালু পাহাড়ে গড়াতে গড়াতে অনেকদূর নীচে ঝরনার মধ্যে পড়তে কতক্ষণ লাগত। কী যে হতে পারত লেটা এতখানি করে মা'র কাছে বলেছি। তা ছাড়া ঘন পাইনের বনে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ ভালুকের সঙ্গে দেখা হলেও হতে পারত, এও একটা শোনাবার মতো জিনিস ছিল বটে। ঘটবার মতো কিছুই ঘটে নি, কাজেই অঘটন সৰ জমিয়েছিলুম মনে।