পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/১৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১৩২ রবীন্দ্র-রচনাবলী বিনয়ের আর গোরার বাড়ি যাওয়া হইল না । মনের মধ্যে নানা কথা তোলপাড় করিতে করিতে বিনয় বাসায় ফিরিল। পরদিন অপরাহ্লে বাসা হইতে বাহির হইয়া ঘুরিতে ঘুরিতে অবশেষে যখন গোরার বাড়িতে আসিয়া পৌছিল তখন বর্ষার দীর্ঘদিন শেষ হইয়া সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হইয়া উঠিয়াছে। গোরা সেই সময় আলোটি জালাইয়া লিখিতে বসিয়াছে । গোরা কাগজ হইতে মুখ ন তুলিয়াই কহিল, "কী গো বিনয়, হাওয়া কোন দিক থেকে বইছে ?” বিনয় সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া কহিল, “গোরা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি— ভারতবর্ষ তোমার কাছে খুব সত্য ? খুব স্পষ্ট? তুমি তো দিনরাত্রি তাকে মনে রাখ, কিন্তু কী-রকম ক'রে মনে রাথ ?" গোরা লেখা ছাড়িয়া কিছুক্ষণ তাহার তীক্ষ দৃষ্ট লইলু বিনয়ের মুথের দিকে চাহিল ; তাহার পরে কলমটা রাখিয়া চৌকির পিঠের দিকে ঠেস দিয়া কহিল, "জাহাজের কাপ্তেন যখন সমুদ্রে পাড়ি দেয় তখন যেমন আহারে বিহারে কাজে বিশ্রামে সমুদ্রপারের বন্দরটিকে সে মনের মধ্যে রেখে দেয় আমার ভারতবর্ষকে আমি তেমনি করে মনে রেখেছি।" বিনয় । কোথায় তোমার সেই ভারতবর্ষ ? গোর বুকে হাত দিয়া কহিল, "আমার এইখনকার কম্পাসট দিন রাত যেখানে কাটা ফিরিয়ে আছে সেইখানে, তোমার মার্শম্যান সাহেবের হিস্ট্রি অব ইণ্ডিয়ার মধ্যে নয় ।” বিনয় । তোমার কাটা যে দিকে, সে দিকে কিছু একটা আছে কি ? গোরা উত্তেজিত হইয়া কহিল, ”আছে না তো কী ? আমি পথ ভুলতে পারি, ডুবে মরতে পারি, কিন্তু আমার সেই লক্ষ্মীর বন্দরটি আছে । সেই আমার পূর্ণস্বরূপ ভারতবর্ষ– ধনে পূর্ণ, জ্ঞানে পূর্ণ, ধর্মে পূর্ণ— সে ভারতবর্ষ কোথাও নেই । আছে কেবল চারি দিকের এই মিথ্যেটা ! এই তোমার কলকাতা শহর, এই অপিস, এই আদালত, এই গোটাকতক ইটকাঠের বুদবুদ ! ছে: " বলিয়া গোর বিনয়ের মূপের দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ চাহিয়া রছিল— বিনয় কোনো উত্তর না করিয় ভাবিতে লাগিল । গোরা কঠিল, “এই যেখানে আমরা পড়ছি শুনছি, চাকরির উমেদারি করে বেড়াচ্ছি, দশটা-পাচটায় কৃতের খাটুনি খেটে কী যে করছি তার কিছুষ্ট ঠিকানা নেই, এই জাদুকরের মিথ্যে ভারতবর্ধটাকেই আমরা সত্য বলে ঠাউরেছি বলেই পচিশ কোটি লোক মিথ্যে মানকে মান বলে, মিথ্যে কর্মকে