পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোর &〉》 দুই জনে রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল । বাকি পথ গোরা আর কোনো কথা কহিল না । ভেস্কের মধ্যে ওই ছবিখানি দেখিয়া গোরাকে আবার সহসা স্মরণ করাইয়া দিল যে, বিনয়ের চিত্তের একটা প্রধান ধারা এমন একটা পথে চলিয়াছে যে পথের সঙ্গে গোরার জীবনের কোনো সম্পর্ক নাই । ক্রমে বন্ধুত্বের আদিগঙ্গা নিজীব হইয়া ওই দিকেই মূল ধারাটা বহিতে পারে এ আশঙ্কা অব্যক্তভাবে গোরার হৃদরের গভীরতম তলদেশে একটা অনির্দেগু ভারের মতে চাপিয়া পড়িল । সমস্ত চিন্তায় ও কর্মে এতদিন দুই বন্ধুর মধ্যে কোনো বিচ্ছেদ ছিল না— এখন আর তাহ রক্ষণ করা কঠিন হইতেছে – বিনয় এক জায়গায় স্বতন্ত্র হইয়া উঠিতেছে। গোরা যে কেন চুপ করিয়া গেল বিনয় তাহা বুঝিল । কিন্তু এই নীরবতার বেড়া গায়ে পড়িয়া ঠেলিয়া ভাঙিতে তাহার সংকোচ বোধ হইল । গোরার মনটা যে জায়গায় আসিয়া ঠেকিতেছে সেখানে একটা সত্যকার ব্যবধান আছে ইহা বিনয় নিজেও অনুভব করে । বাড়িতে আসিয়া পৌছিতেই দেখা গেল মহিম পথের দিকে চাহিয়া দ্বারের কাছে দাড়াইয়া আছেন । দুই বন্ধুকে দেখিয়া তিনি কছিলেন, “ব্যাপারখানা কী ! কাল তো তোমাদের সমস্ত রাত না ঘুমিয়েই কেটেছে— আমি ভাবছিলুম দুজনে বুঝি বা ফুটপাপের উপরে কোথাও আরামে ঘুমিয়ে পড়েছ ! বেলা তো কম হয় নি। যাও বিনয়, নাইতে যা ও ” বিনয়কে তাগিদ করিয়া নাহিতে পাঠাষ্টয়া মহিম গোরাকে লইয়া পড়িলেন ; কছিলেন, “দেখো গোরা, তোমাকে যে কথাটা বলেছিলুম সেটা একটু বিবেচনা করে দেখো । বিনয়কে যদি তোমার অনাচারী বলে সন্দেহ হয় তা হলে আজকালকার বাজারে হিন্দু পায় পাব কোথায় ? শুধু হিদুল্লানি হলেও তো চলবে না— লেখাপড়াও তো চাই ! ওই লেখাপড়াতে হিছানিতে মিললে যে পদার্থ টা হয় সেটা আমাদের হিন্দুমতে ঠিক শাস্ত্রীয় জিনিস নয় বটে, কিন্তু মন্দ জিনিসও নয়। যদি তোমার মেয়ে থাকত তা হলে এ বিষয়ে আমার সঙ্গে তোমার মভের ঠিক মিল হয়ে যেত ।” গোরা কহিল, “তা, বেশ তো— বিনয় বোধ হয় আপত্তি করবে না ।" মহিম কহিল, "শোনো এক বার ! বিনয়ের আপত্তির জন্ত কে ভাবছে । তোমার আপত্তিকেই তো ভরাই । তুমি নিজের মুখে একবার বিনয়কে অনুরোধ করো, আমি আর কিছু চাই নে— তাতে যদি ফল না হয় তো না হবে ।” গোয়া কছিল, ”আচ্ছা ।”