পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা ২৩৩ বিস্তারিত করিয়া গোরাকে বলিতে লাগিল । স্বচরিতা যে বিশেষ আগ্রহের সহিত এ-সকল প্রসঙ্গ আপনি উত্থাপিত করে এবং যতই তর্ক করুক-না কেন মনের অলক্ষ্য দেশে সে যে এক্রমশই অল্প অল্প করিয়া সায় দিতেছে, এ কথা জানাইয়া গোরাকে বিনয় উৎসাহিত করিবার চেষ্টা করিল। বিনয় গল্প করিতে করিতে কহিল, “নন্দর মা ভূতের ওঝা এনে নন্দকে কী করে মেরে ফেলেছে এবং তাই নিয়ে তোমার সঙ্গে কী কথা হয়েছিল তাই যখন বলছিলুম তখন তিনি বললেন, “আপনারা মনে করেন ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে মেয়েদের রাধতে বাড়তে আর ঘর নিকোতে দিলেই তাদের সমস্ত কর্তব্য হয়ে গেল । এক দিকে এমনি করে তাদের বুদ্ধিশুদ্ধি সমস্ত থাটো করে রেখে দেবেন, তার পরে যখন তারা ভূতের ওঝা ডাকে তখনও আপনারা রাগ করতে ছাড়বেন না । যাদের পক্ষে দুটি-একটি পরিবারের মধ্যেই সমস্ত বিশ্বজগং তারা কখনোই সম্পূর্ণ মানুষ হতে পারে না— এবং তারা মানুষ না হলেই পুরুষের সমস্ত বড়ো কাজকে নষ্ট করে অসম্পূর্ণ ক’রে পুরুষকে তারা নীচের দিকে ভারাক্রাস্ত ক’রে নিজেদের দুর্গতির শোধ তুলবেই। নম্বর মাকে আপনারা এমন করে গড়েছেন এবং এমন জায়গায় ঘিরে রেখেছেন যে, আজ প্রাণের দায়েও আপনারা যদি তাকে স্ববুদ্ধি দিতে চান তো সেখানে গিয়ে পৌছবেই না । আমি এ নিয়ে তর্ক করবার অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু সত্য বলছি গোরা, মনে মনে তার সঙ্গে মতের মিল হওয়াতে আমি জোরের সঙ্গে তর্ক করতে পারি নি। তার সঙ্গে তবু তর্ক চলে, কিন্তু ললিতার সঙ্গে তর্ক করতে আমার সাহস হয় না। ললিতা যখন ভ্র তুলে বললেন, “আপনারা মনে করেন, জগতের কাজ আপনার করবেন, আর আপনাদের কাজ আমরা করব । সেটি হবার জো নেই । জগতের কাজ হয় আমরাও চালাব, নয় আমরা বোঝা হয়ে থাকব ; আমরা যদি বোঝা হুই– তখন রাগ করে বলবেন : পথে নারী বিবর্জিত ! কিন্তু নারীকেও যদি চলতে দেন, তা হলে পথেই হোক আর ঘরেই হোক নারীকে বিবর্জন করার দরকার হয় না ।” তখন আমি আর কোনো উত্তর না করে চুপ করে রইলুম। ললিতা সহজে কথা কন না, কিন্তু যখন কন তখন খুব সাবধানে উত্তর দিতে হয় । যাই বল গোরা, আমারও মনে খুব বিশ্বাস হয়েছে যে আমাদের মেয়েরা যদি চীন-রমণীদের পায়ের মতো সংকুচিত হয়ে থাকে তা হলে আমাদের কোনো কাজ এগোবে না।” গোরা । মেয়েদের শিক্ষণ দেওয়া হবে না, এমন কথা তো আমি কোনো দিন বলি নে । বিনয় । চারুপাঠ তৃতীয় ভাগ পড়ালেই বুঝি শিক্ষা দেওয়া হয় ?