পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা O8(? খাইয়া কাটাইতে লাগিলেন । স্বচরিতা ইহাতে অত্যন্ত কষ্ট পাইল । মালি তাহাকে অনেক করিয়া বুঝাইয়া বলিলেন, "মা, এ আমার বড়ে ভালো হয়েছে। এই আমার প্রয়োজন ছিল । এতে আমার কোনো কষ্ট নেই, আমার আনন্দই হয় ।” স্বচরিতা কছিল, “মালি, আমি যদি অন্ত জাতের হাতে জল বা খাবার না খাই তা হলে তুমি আমাকে তোমার কাজ করতে দেবে ?” # হরিমোহিনী কছিলেন, "কেন মা, তুমি যে ধর্ম মান সেই মতেই তুমি চলো— আমার জন্তে তোমাকে অন্ত পথে যেতে হবে না। আমি তোমাকে কাছে পেয়েছি, বুকে রাখছি, প্রতিদিন দেখতে পাই, এই আমার আনন্দ । পরেশবাৰু তোমার গুরু, তোমার বাপের মতো, তিনি তোমাকে ষে শিক্ষা দিয়েছেন তুমি সেই মেনে চলো, তাতেই ভগবান তোমার মঙ্গল করবেন।” হরিমোহিনী বরদাসুন্দরীর সমস্ত উপদ্রব এমন করিয়া সহিতে লাগিলেন যেন তাহা তিনি কিছুই বুঝিতে পারেন নাই। পরেশবাবু যখন প্রত্যহ আসিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতেন— কেমন আছেন, কোনো অসুবিধা হইতেছে না তো— তিনি বলিতেন, “আমি খুব স্বখে আছি।” কিন্তু বরদাসুন্দরীর সমস্ত অন্যায় মুচরিতাকে প্রতি মুহূর্তে জর্জরিত করিতে লাগিল। সে তো নালিশ করিবার মেয়ে নয় ; বিশেষত পরেশবাবুর কাছে বরদাসুন্দরীর ব্যবহারের কথা বলা তাহার দ্বারা কোনোমতেই ঘটিতে পারে না । সে নি:শব্দে সমস্ত সহ করিতে লাগিল— এ সম্বন্ধে কোনো প্রকার আক্ষেপ প্রকাশ করিতেও তাহার অত্যন্ত সংকোচ বোধ হইত । ইহার ফল হইল এই যে, স্বচরিতা ধীরে ধীরে সম্পূর্ণভাবেই তাহার মাসির কাছে আসিয়া পড়িল । মাসির বারম্বার নিষেধসত্ত্বেও আহার-পান সম্বন্ধে সে তাহারই সম্পূর্ণ অম্বুবতী হইয়া চলিতে লাগিল । শেষকালে স্বচরিতার কষ্ট হইতেছে দেখিয়া দায়ে পড়িয়া হরিমোহিনীকে পুনরায় রন্ধনাদিতে মন দিতে হইল । স্বচরিতা কহিল, “মালি, তুমি আমাকে যেমন করে থাকতে বল আমি তেমনি করেই থাকব, কিন্তু তোমার জল আমি নিজে তুলে দেব, সে আমি কিছুতেই ছাড়ব না ।” হরিমোহিনী কছিলেন, “মা, তুমি কিছুই মনে কোরো না, কিন্তু ওই জলে যে আমার ঠাকুরের ভোগ হয় ।” স্বচরিতা কছিল, "মালি, তোমার ঠাকুরও কি জাত মানেন ? তাকেও কি পাপ লাগে ? তারও কি সমাজ আছে না কি ?” অবশেষে এক দিন স্বচরিতার নিষ্ঠার কাছে হরিমোহিনীকে হার মানিতে হইল ।