পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ෂ69 রবীন্দ্র-রচনাবলী তাহার প্রতি চিত্তকে প্রতিকুল করিয়া রছিলেন, এই বেদনাই স্বচরিতাকে সব চেয়ে বেশি করিয়া বাজিতে লাগিল । লাবণ্য ললিতা লীলা স্বচরিতার সঙ্গে সঙ্গেই ফিরিতে লাগিল । তাহারা অত্যন্ত উৎসাহ করিয়া তাহার নূতন বাড়ির ঘর সাজাইতে গেল, কিন্তু সেই উৎসাহের ভিতরেও অব্যক্ত বেদনার অশ্রুজল প্রচ্ছন্ন হইয়া ছিল । এতদিন পর্যস্ত স্বচরিতা নানা ছুতা করিয়া পরেশবাবুর কত-কী ছোটোখাটো কাজ করিয়া আসিয়াছে। হয়তো ফুলদানিতে ফুল সাজাইয়াছে, টেবিলের উপর বই গুছাইয়াছে, নিজের হাতে বিছানা রৌদ্রে দিয়াছে, স্নানের সময় প্রত্যহ তাহাকে খবর দিয়া স্মরণ করাইয়া দিয়াছে— এই সমস্ত অভ্যস্ত কাজের কোনো গুরুত্বই প্রতিদিন কোনো পক্ষ অনুভব করে না । কিন্তু এ-সকল অনাবশ্বক কাজও যখন বন্ধ করিয়া চলিয়া যাইবার সময় উপস্থিত হয় তখন এই-সকল ছোটোখাটো সেবা, যাহা এক জনে না করিলে অনায়াসে আর-এক জনে করিতে পারে, যাহা না করিলেও কাহারও বিশেষ কোনো ক্ষতি হয় না, এইগুলিই দুই পক্ষের চিত্তকে মথিত করিতে থাকে স্বচরিতা আজকাল যখন পরেশের ঘরের কোনো সামান্ত কাজ করিতে আসে তখন সেই কাজটা পরেশের কাছে মস্ত হইয়া দেখা দেয় ও র্তাহার বক্ষের মধ্যে একটা দীর্ঘনিশ্বাস জমা হইয়া উঠে । এবং এই কাজ আজ বাদে কাল অন্যের হাতে সম্পন্ন হইতে থাকিবে এই কথা মনে করিয়া স্বচরিতার চোখ ছলছল করিয়া আসে । যেদিন মধ্যাহ্নে আহার করিয়া স্বচরিতাদের নূতন বাড়িতে উঠিয়া যাইবার কথা সেদিন প্রাতঃকালে পরেশবাবু তাহার নিভৃত ঘরটিতে উপাসনা করিতে আসিয়া দেখিলেন, তাহার আসনের সম্মুখদেশ ফুল দিয়া সাজাইয়া ঘরের এক প্রাস্তে স্বচরিতা অপেক্ষা করিয়া বসিয়া আছে । লাবণ্য-লীলারাও উপাসনাস্থলে আজ আসিবে এইরূপ তাহারা পরামর্শ করিয়াছিল, কিন্তু ললিত তাহাদিগকে নিষেধ করিয়া আসিতে দেয় নাই । ললিতা জানিত, পরেশবাবুর নির্জন উপাসনায় ৰোগ দিয়া স্বচরিতা যেন বিশেষভাবে তাহার আনন্দের অংশ ও আশীৰ্বাদ লাভ করিত— আজ প্রাতঃকালে সেই আশীৰ্বাদ সঞ্চয় করিয়া লইবার জন্য সুচরিতার যে বিশেষ প্রয়োজন ছিল তাহাই অনুভব করিয়া ললিতা অন্তকার উপাসনার নির্জনতা ভঙ্গ করিতে দেয় নাই । উপাসনা শেষ হইয়া গেল। তখন সুচরিতার চোখ দিয়া জল পড়িতেছে, পরেশবাবু কহিলেন, “মা, পিছন দিকে ফিরে তাকিয়ো না, সম্মুখের পথে অগ্রসর হয়ে যাও– মনে সংকোচ রেখো না । যাই ঘটুক, যাই তোমার সম্মুখে উপস্থিত হোক, তার থেকে সম্পূর্ণ নিজের শক্তিতে ভালোকে গ্রহণ করবে এই পণ করে আনন্দের