পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী ویه 8 ইহাতে সে অত্যন্ত লজ্জিত ও সংকুচিত হইয়া উঠিল। তাহার কেবলই মনে হইতে লাগিল তাহার সঙ্গে পরিচয়কে ললিতা অভিশাপ ও ধিক্কার দিতেছে। মনে হইতে লাগিল, তাহার দৃষ্টিমাত্রও ললিতা আর কোনোদিন সহ করিতে পারিবে না। হায় রে, মানবহৃদয় ! এই অত্যস্ত ধিক্কারের মধ্যেও বিনয়ের চিত্তের মধ্যে একটি নিবিড় গভীর সূক্ষ্ম ও তীব্র আনন্দ এক প্রাস্ত হইতে আর-এক প্রাস্তে সঞ্চরণ করিতে ছিল, তাহাকে থামাইয়া রাখা যাইতেছিল না— সমস্ত লজ্জা সমস্ত অপমানকে সে অস্বীকার করিতেছিল। সেইটেকেই কোনোমতে কিছুমাত্র প্রশ্রয় না দিবার জন্ত তাহার বারান্দায় সে দ্রুতবেগে পায়চারি করিয়া বেড়াইতে লাগিল— কিন্তু সকালবেলার আলোকের ভিতর দিয়া একটা মদিরতা তাহার মনে সঞ্চারিত হইল— রাস্তা দিয়া ফেরিওয়ালা হাকিয়া যাইতেছিল, তাহার সেই হাকের স্বরও তাহার হৃদয়ের মধ্যে একটা গভীর চাঞ্চল্য জাগাইল । বাহিরের লোকনিন্দাই যেন ললিতাকে বন্যার মতো ভাসাইয়া বিনয়ের হৃদয়ের ভাঙার উপর তুলিয়া দিয়া গেল— ললিতার এই সমাজ হইতে ভাসিয়া আসার মূর্তিটিকে সে আর ঠেকাইয়া রাখিতে পারিল না। তাছার মন কেবলই বলিতে লাগিল, "ললিতা আমার, একলাই আমার P অন্ত কোনোদিন তাহার মন দুর্দাম হইয়া এত জোরে এ কথা বলিতে সাহস করে নাই ; আজ বাহিরে যখন এই ধ্বনিটা এমন করিয়া হঠাৎ উঠিল তখন বিনয় কোনোমতেই নিজের মনকে আর চুপ চুপ! বলিয়া থামাইয়া রাখিতে পারিল না। বিনয় এমনি চঞ্চল হইয়া যখন বারান্দায় বেড়াইতেছে এমন সময় দেখিল হারানবাৰু রাস্তা দিয়া আসিতেছেন। তৎক্ষণাং বুঝিতে পারিল তিনি তাহারই কাছে আসিতেছেন এবং অনামা চিঠিটার পশ্চাতে যে একটা বৃহং আলোড়ন আছে তাহাও নিশ্চয় জানিল । i অন্য দিনের মতে বিনয় তাহার স্বভাবসিদ্ধ প্ৰগলভতা প্রকাশ করিল না ; সে হারানবাবুকে চেকিতে বসাইয়া নীরবে তাহার কথার প্রতীক্ষা করিয়া রহিল। হারানবাবু কহিলেন, “বিনয়বাবু, আপনি তো হিন্দু ?” বিনয় কহিল, “হা, হিন্দু বইকি।” হারানবাবু কছিলেন, “আমার এ প্রশ্নে রাগ করবেন না। অনেক সময় আমরা চারি দিকের অবস্থা বিবেচনা না করে অন্ধ হয়ে চলি— তাতে সংসারে দুঃখের সৃষ্টি করে। এমন স্থলে, আমরা কী, আমাদের সীমা কোথায়, আমাদের আচরণের ফল কতদূর পর্যন্ত পৌঁছয়, এ-সমস্ত প্রশ্ন যদি কেউ উত্থাপন করে, তবে তা অপ্রিয় হলেও, তাকে বন্ধু বলে মনে জানবেন।”