পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8&br রবীন্দ্র-রচনাবলী স্বচরিতা উঠিয়া দাড়াইয়া গোরাকে নমস্কার করিল। গোরা কছিল, "এই-বে, আপনি এসেছেন— বহন ।” গোরা এমন করিয়া বলিল ‘আপনি এসেছেন, যেন স্বচরিতার আলা একটা সাধারণ ঘটনার মধ্যে নয়, এ ষেন একটা বিশেষ আবির্ভাব । এক দিন স্বচরিতার সংস্রব হইতে গোর পলায়ন করিয়াছিল। যত দিন পর্যস্ত সে নানা কষ্ট এবং কাজ লইয়া ভ্রমণ করিতেছিল তত দিন স্বচরিতার কথা মন থেকে অনেকটা দূরে রাখিতে পারিয়াছিল। কিন্তু জেলের অবরোধের মধ্যে স্বচরিতার স্মৃতিকে সে কোনোমতেই ঠেকাইয়া রাখিতে পারে নাই। এমন এক দিন ছিল যখন ভারতবর্ষে যে স্ত্রীলোক আছে সে কথা গোরার মনে উদয়ই হয় নাই। এই সত্যটি এতকাল পরে সে স্বচরিতার মধ্যে নূতন আবিষ্কার করিল। একেবারে এক মুহূর্তে এতবড়ো একটা পুরাতন এবং প্রকাগু কথাটাকে হঠাৎ গ্রহণ করিয়া তাহার সমগ্র বলিষ্ঠ প্রকৃতি ইহার আঘাতে কম্পিত হইয়া উঠিল । জেলের মধ্যে বাহিরের স্বর্যালোক এবং মুক্ত বাতাসের জগং যখন তাহার মনের মধ্যে বেদনা সঞ্চার করিত তখন সেই জগংটিকে কেবল সে নিজের কর্মক্ষেত্র এবং কেবল সেটাকে পুরুষসমাজ বলিয়া দেখিত না ; যেমন করিয়াই সে ধ্যান করিত বাহিরের এই সুন্দর জগৎসংসারে সে কেবল দুটি অধিষ্ঠাত্রী দেবতার মুখ দেখিতে পাইত, স্বৰ্ষ চন্দ্র তারার আলোক বিশেষ করিয়া তাহাদেরই মুখের উপর পড়িত, স্নিগ্ধ নীলিমামণ্ডিত আকাশ তাহদেরই মুখকে বেষ্টন করিয়া থাকিত— একটি মুখ তাহার আজন্মপরিচিত মাতার, বুদ্ধিতে উদ্ভালিত আরএকটি নম্র স্বন্দর মুখের সঙ্গে তাহার নূতন পরিচয় । জেলের নিরানন্দ সংকীর্ণতার মধ্যে গোরা এই মুখের স্বতির সঙ্গে বিরোধ করিতে পারে নাই। এই ধ্যানের পুলকটুকু তাহার জেলখানার মধ্যে একটি গভীরতর মুক্তিকে আনিয়া দিত। জেলখানার কঠিন বন্ধন তাহার কাছে যেন ছায়াময় মিথ্যা স্বপ্নের মতো হইয়া যাইত স্পন্দিত হৃদয়ের অতীন্দ্রিয় তরঙ্গগুলি জেলের সমস্ত প্রাচীর অবাধে ভেদ করিয়া আকাশে মিশিয়া সেখানকার পুপপল্পবে হিল্পোলিত এবং সংসারকর্মক্ষেত্রে লীলায়িত হইতে থাকিত । গোরা মনে করিয়াছিল, কল্পনামূর্তিকে ভয় করিবার কোনো কারণ নাই। এইজন্স এক মাল কাল ইহাকে একেবারেই সে পথ ছাড়িয়া দিয়াছিল । গোরা জানিত, ভয় করিবার বিষয় কেবলমাত্র বাস্তব পদার্থ। # জেল হইতে বাহির হইবামাত্র গোরা যখন পরেশবাবুকে দেখিল তখন তাহার মন আনন্দে উচ্ছসিত হইয়া উঠিয়াছিল। সে যে কেবল পরেশবাবুকে দেখার আনন্দ