পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 8ግ© পরিমাণগত অসীমকে তুমি অসীম বল, সেই জন্তেই চোখ বুজে তোমাকে অসীমের কথা ভাবতে হয়, জানি নে তাতে কোনো ফল পাও কিনা। কিন্তু হৃদয়ের অসীমকে চোখ মেলে এতটুকু পদার্থের মধ্যেও পাওয়া যায় । তাই যদি না পাওয়া যেত তবে তোমার মাসির যখন সংসারের সমস্ত স্বথ নষ্ট হয়ে গেল তখন তিনি ওই ঠাকুরটিকে এমন করে আঁকড়ে ধরতে পারতেন কি ? হৃদয়ের অত বড়ো শূন্তত কি খেলাচ্ছলে এক টুকরো পাথর দিয়ে ভরানো যায় ? ভাবের অসীমতা না হলে মামুষের হৃদরের ফাকা ভরে না ।” এমন সকল স্বল্প তর্কের উত্তর দেওয়া স্বচরিতার অসাধ্য, অথচ ইহাকে সত্য বলিয়া মানিয়া যাওয়াও তাহার পক্ষে একেবারে অসম্ভব। এইজন্ত কেবল ভাষাহীন প্রতিকারহীন বেদন তাহার মনে বাজিতে থাকে । বিরুদ্ধপক্ষের সহিত তর্ক করিবার সময় গোরার মনে কোনোদিন এতটুকু দয়ার সঞ্চার হয় নাই। বরঞ্চ এ সম্বন্ধে শিকারি জন্তুর মতো তাহার মনে একটা কঠোর হিংস্ৰতা ছিল । কিন্তু স্বচরিতার নিরুত্তর পরাভবে আজ তাহার মন কেমন ব্যথিত হইতে লাগিল । সে কণ্ঠস্বরকে কোমল করিয়া কছিল, “তোমাদের ধর্মমতের বিরুদ্ধে আমি কোনো কথা বলতে চাই নে। আমার কথাটুকু কেবল এই, তুমি যাকে ঠাকুর বলে নিন্দ করছ সেই ঠাকুরটি যে কী তা শুধু চোখে দেখে জানাই যায় না ; তাতে যার মন স্থির হয়েছে, হৃদয় তৃপ্ত হয়েছে, যার চরিত্র আশ্রয় পেয়েছে, সেই জানে সে ঠাকুর মুন্ময় কি চিন্ময়, সসীম কি অসীম । আমি তোমাকে বলছি, আমাদের দেশের কোনো ভক্তই সসীমের পূজা করে না— সীমার মধ্যে সীমাকে হারিয়ে ফেলা ওই তো তাদের ভক্তির আনন্দ ।” স্বচরিতা কহিল, “কিন্তু সবাই তো ভক্ত নয়।” গোরা কহিল, “ষে ভক্ত নয় সে কিসের পূজা করে তাতে কার কী আসে যায় ? ব্রাহ্মসমাজে যে লোক ভক্তিহীন লে কী করে ? তার সমস্ত পূজা অতলম্পর্শ শূন্ততার মধ্যে গিয়ে পড়ে। না, শূন্ততার চেয়ে ভয়ানক— দলাদলিই তার দেবতা, অহংকারই তার পুরোহিত । এই রক্তপিপাস্থ দেবতার পূজা তোমাদের সমাজে কি কখনো দেখ নি ?” এই কথার কোনো উত্তর না দিয়া স্বচরিতা গোরাকে জিজ্ঞাসা করিল, "ধর্মসম্বন্ধে আপনি এই ষা-সব বলছেন এ কি আপনি নিজের অভিজ্ঞতার থেকে বলছেন ?” গোরা ঈষৎ হাসিয়া কহিল, "অর্থাৎ, তুমি জানতে চাও, আমি কোনোদিনই ঈশ্বরকে চেয়েছি কিনা। না, আমার মন ও দিকেই যায় নি।” স্বচরিতার পক্ষে এ কথা খুশি হইবার কথা নহে, কিন্তু তবু তাহার মন যেন ইপি