পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Q>8 রবীন্দ্র-রচনাবলী তাকে যা বলেছ সমস্ত ভুল, তুমি আমাকে যা ভাবছ সমস্ত মিথ্যা— তুমি অন্যায় করেছ। তার মতো লোককে নিচু করতে পার তোমার এমন সাধ্য নেই, কিন্তু কেন তুমি আমার উপরে এমন অত্যাচার করলে, আমি তোমার কী করেছি ?” বলিতে বলিতে সুচরিতার স্বর রুদ্ধ হইয়া গেল, সে অন্য ঘরে চলিয়া গেল । হরিমোহিনী হতবুদ্ধি হইয়া গেলেন। তিনি মনে মনে কহিলেন, ‘না বাপু, এমন সব কথা আমি সাত জন্মে শুনি নাই ।” স্বচরিতাকে কিছু শাস্ত হইতে সময় দিয়া কিছুক্ষণ পরে তাহাকে আহারে ডাকিয়া লইয়া গেলেন। সে খাইতে বসিলে তাহাকে বলিলেন, “দেখো রাধারানী, আমার তো বয়স নিতান্ত কম হয় নি। হিন্দুধর্মে যা বলে তা তো শিশুকাল থেকে করে আসছি, আর শুনেওছি বিস্তর। তুমি এ-সব কিছুই জান না, সেইজন্যেই গৌরমোহন তোমার গুরু হয়ে তোমাকে কেবল ভোলাচ্ছে । আমি তো ওর কথা কিছু-কিছু শুনেছি— ওর মধ্যে আদিত কথা কিছুই নেই, ও শাস্ত্র ওঁর নিজের তৈরি, এ-সব আমাদের কাছে ধরা পড়ে, আমরা গুরু-উপদেশ পেয়েছি। আমি তোমাকে বলছি রাধারানী, তোমাকে এ-সব কিছুই করতে হবে না, যখন সময় হবে আমার যিনি গুরু আছেন— তিনি তো এমন ফাকি নন— তিনিই তোমাকে মন্ত্র দেবেন । তোমার কোনো ভয় নেই, আমি তোমাকে হিন্দুসমাজে ঢুকিয়ে দেব । ব্রাহ্মঘরে ছিলে, নাহয় ছিলে । কেই বা সে খবর জানবে! তোমার বয়স কিছু বেশি হয়েছে বটে, তা এমন বাড়ন্ত মেয়ে ঢের আছে। কেই বা তোমার কুষ্ঠি দেখছে! আর টাকা যখন আছে তখন কিছুতেই কিছু বাধবে না, সবই চলে যাবে । কৈবর্তের ছেলে কায়স্থ বলে চলে গেল, সে তো আমি নিজের চক্ষে দেখেছি। আমি হিন্দুসমাজে এমন সদব্ৰাহ্মণের ঘরে তোমাকে চালিয়ে দেব, কারও সাধ্য থাকবে না কথা বলে— তারাই হল সমাজের কর্তা। এজন্যে তোমাকে এত গুরুর সাধ্যসাধনা, এত কান্নাকাটি ক’রে মরতে হবে না ।” এই-সকল কথা হরিমোহিনী যখন বিস্তারিত করিয়া ফলাইয়া ফলাইয়া বলিতে ছিলেন, স্বচরিতার তখন আহারে রুচি চলিয়া গিয়াছিল, তাহার গলা দিয়া যেন গ্রাস গলিতেছিল না । কিন্তু সে নীরবে অত্যস্ত জোর করিয়াই খাইল ; কারণ, সে জানিত তাহার কম খাওয়া লইয়াই এমন আলোচনার স্বষ্টি হইবে যাহা তাহার পক্ষে কিছুমাত্র উপাদেয় হইবে না । হরিমোহিনী ষখন মুচরিতার কাছে বিশেষ কোনো সাড়া পাইলেন না তখন তিনি মনে মনে কছিলেন, ‘গড় করি, ইহাদিগকে গড় করি। এদিকে হিন্দু হিন্দু