পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(రిషా রবীন্দ্র-রচনাবলা নিবিড়ভাবে পরস্পরের পার্শ্বে আসিয়া সমবেত হয় হিন্দুরা এমন হয় না। গোরা বার বার চিস্তা করিয়া দেখিয়াছে এই দুই নিকটতম প্রতিবেশী সমাজের মধ্যে এতবড়ো প্রভেদ কেন হইল। যে উত্তরটি তাহার মনে উদিত হয় সে উত্তরটি কিছুতেই তাহার মানিতে ইচ্ছা হয় না। এ কথা স্বীকার করিতে তাহার সমস্ত হৃদয় ব্যথিত হইয়া উঠতে লাগিল যে, ধর্মের দ্বারা মুসলমান এক, কেবল আচারের দ্বারা নহে। এক দিকে যেমন আচারের বন্ধন তাহদের সমস্ত কর্মকে অনর্থক বাধিয়া রাখে নাই, অন্য দিকে তেমনি ধর্মের বন্ধন তাহদের মধ্যে একান্ত ঘনিষ্ঠ । তাহারা সকলে মিলিয়া এমন একটি জিনিসকে গ্রহণ করিয়াছে যাহা না?-মাত্র নহে, যাহা ‘ই’ ; যাহা ঋণাত্মক নহে, যাহা ধনাত্মক ; যাহার জন্য মানুষ এক আহবানে এক মুহূর্তে এক সঙ্গে দাড়াইয়া অনায়াসে প্রাণবিসর্জন করিতে পারে । শিক্ষিতসমাজে গোরা যখন লিখিয়াছে, তর্ক করিয়াছে, বক্তৃতা দিয়াছে, তখন সে অন্যকে বুঝাইবার জন্য, অন্যকে নিজের পথে আনিবার জন্য, স্বভাবতই নিজের কথাগুলিকে কল্পনার দ্বারা মনোহর বর্ণে রঞ্জিত করিয়াছে ; যাহা স্থল তাহাকে সূক্ষ্ম ব্যাখ্যার দ্বারা আবৃত করিয়াছে, যাহা অনাবশ্ব)ক ভগ্নাবশেষমাত্র তাহাকেও ভাবের চন্দ্রালোকে মোহময় ছবির মতো করিয়া দেখাইয়াছে। দেশের এক দল লোক দেশের প্রতি বিমুখ বলিয়াই, দেশের সমস্তই তাহারা মন্দ দেখে বলিয়াই, স্বদেশের প্রতি প্রবল অনুরাগ-বশত গোরা এই মমত্ববিহীন দৃষ্টিপাতের অপমান হইতে বাচাইবার জন্য স্বদেশের সমস্তকেই অত্যুজ্জল ভাবের আবরণে ঢাকিয়া রাথিতে অহোরাত্র চেষ্টা করিয়াছে । ইহাই গোরার অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছিল । সবই ভালো, যাহাকে দোষ বলিতেছ তাহা কোনো একভাবে গুণ, ইহা যে গোরা কেবল উকিলের মতো প্রমাণ করিত তাহা নহে, ইহাই সে সমস্ত মন দিয়া বিশ্বাস করিত । নিতাস্ত অসম্ভব স্থানেও এই বিশ্বাসকে স্পর্ধার সহিত জয়পতাকার মতো দৃঢ় মুষ্টিতে সমস্ত পরিহাসপরায়ণ শত্ৰুপক্ষের সম্মুখে সে এক খাড়া করিয়া দাড়াইয়াছে । তাহার কেবল একটিমাত্র কথা ছিল, স্বদেশের প্রতি স্বদেশবাসীর শ্রদ্ধা সে ফিরাইয়া আনিবে, তাহার পরে অন্ত কাজ । কিন্তু যখন সে পল্লীর মধ্যে প্রবেশ করে তপন তো তাহার সম্মুখে কোনো শ্রোতা থাকে না, তখন তো তাহার প্রমাণ করিবার কিছুই নাই, অবজ্ঞা ও বিদ্বেষকে নত করিয়া দিবার জন্য তাহার সমস্ত বিরুদ্ধ শক্তিকে জাগ্ৰত করিয়া তুলিবার কোনো প্রয়োজন থাকে না— এইজন্য সেখানে সত্যকে সে কোনোপ্রকার আবরণের ভিতর দিয়া দেখে না। দেশের প্রতি তাহার অনুরাগের প্রবলতাই তাহার সত্যষ্টিকে অসামান্তরূপে তীক্ষ করিয়া দেয় ।