পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ठळ९3 8br> • সে-ভাগ তো বাইরে, কেবল চোখে দেখার ভাগ । অন্তরে তো প্ৰাণের মধ্যে ভাগ হয় না । আজ তোমাকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে নেবার ধাক্কা এসেছে। আমাকে যে এত বেশি বাজবে এ আমি কোনোদিন ভাবতেই পারতুম না। সরি, তুমি কি জািন কী ধাক্কাটা এল। হঠাৎ আমাদের পরে ।” “জানি ভাই, তুমি জানিবার আগে থাকতেই ৷” “সইতে পারবে সরি ?” “সইতেই হবে ।” “মেয়েদের সহ্য করবার শক্তি কি আমাদের চেয়ে বেশি, তাই ভাবি ।” “তোমরা পুরুষমানুষ দুঃখের সঙ্গে লড়াই কর, মেয়েরা যুগে যুগে দুঃখ কেবল সহাই করে । চোখের জল আর ধৈর্য, এ ছাড়া আর তো কিছুই সম্বল নেই তাদের।” “তোমাকে আমার কাছ থেকে ছিড়ে নিয়ে যাবে এ আমি ঘটতে দেব না, দেব না। এ অন্যায়, এ নিষ্ঠুর অন্যায়।”—বলে মুঠো শক্ত করে আকাশে কোন অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে লড়াই করতে প্ৰস্তুত হল। বলে গেল যেন আপন মনে ধীরে ধীরে, “ন্যায় অন্যায়ের কথা নয় ভাই, সম্বন্ধের বন্ধন যখন ফাস হয়ে ওঠে তার ব্যথা বাজে। নানা লোকের মধ্যে, টানাটানি পড়ে নানা দিক থেকে, কাকেই বা দোষ দেব ।” “তুমি সহ্য করতে পারবে তা জানি। একদিনের কথা মনে পড়ছে। কী চুল ছিল তোমার, এখনো আছে। সে চুলের গর্ব ছিল তোমার মনে । সবাই সেই গর্বে প্রশ্রয় দিত। একদিন ঝগড়া হল তোমার সঙ্গে। দুপুরবেলা বালিশের পরে চুল মেলে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলে, আমি কঁচি হাতে অন্তত আধহাতখনেক কেটে দিলাম। তখনই জেগে তুমি দাঁড়িয়ে উঠলে, তোমার ঐ কালো চোখ আরো কালো হয়ে উঠল। শুধু বললে, “মনে করেছ। আমাকে জব্দ করবে ?’ বলে আমার হাত থেকে কাচি টেনে নিয়ে ঘাড় পর্যন্ত চুল কেটে ফেললে কচ কচ করে। মেসোমশায় তোমাকে দেখে আশ্চর্য। বললেন, “এ কী কাণ্ড ।” তুমি শান্তমুখে অনায়াসে বললে, “বড়ো গরম লাগে।” তিনিও একটু হেসে সহজেই মেনে নিলেন । প্রশ্ন করলেন না, ভৎসনা করলেন না, কেবল কঁচি নিয়ে সমান করে দিলেন তোমার চুল। তোমারই তো জেঠামশায় ।” সরলা হেসে বললে, “তোমার যেমন বুদ্ধি ! তুমি ভাবছ। এটা আমার ক্ষমার পরিচয় ? একটুকুও নয়। সেদিন তুমি আমাকে যতটা জব্দ করেছিলে তার চেয়ে অনেক বেশি জব্দ করেছিলুম। আমি তোমাকে । ঠিক কি না বলে ।” “খুব ঠিক | সেই কাটা চুল দেখে আমি কেবল কঁদিতে বাকি রেখেছিলুম। তার পরদিন তোমাকে । মুখ দেখাতে পারি নি লজ্জায়। পড়বার ঘরে চুপ করে ছিলেম বসে। তুমি ঘরে ঢুকেই হাত ধরে আমাকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেলে বাগানের কাজে, যেন কিছুই হয় নি। আর-একদিনের কথা মনে পড়ে, সেই যেদিন ফাল্লুন মাসে অকালে ঝড় উঠে আমার বিছন লাগাবার ঘরের চাল উড়িয়ে নিয়েছিল তখন তুমি এসে—” "থােক। আর বলতে হবে না আদিতদা” বলে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে, “সে-সব দিন আর আসবে না।” বলেই তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল। আদিত্য ব্যাকুল হয়ে সরলার হাত চেপে ধরে বললে, “না যেয়ে না, এখনই যেয়ে না, কখন এক সময়ে যাবার দিন আসবে তখন—” বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে কলে উঠল, “কোনোদিন কেন যেতে হবে। কী অপরাধ ঘটেছে। ঈর্ষা ! আজি দশ বৎসর সংসারযাত্রায় আমার পরীক্ষা হল, তারই এই পরিণাম ? কী নিয়ে ঈর্ষা। তা থলে তো তেইশ বছরের ইতিহাস মুছে ফেলতে হয়, যখন থেকে তোমার সঙ্গে আমার দেখা ।” "তেইশ বছরের কথা বলতে পারি। নে ভাই, কিন্তু তেইশ বছরের এই শেষ বেলাতে ঈর্ষার কি কোনাে কারণই ঘটে নি। সত্যি কথা তো বলতে হবে। নিজেকে ভুলিয়ে লাভ কী। তোমার আমার মধ্যে কোনো কথা যেন অস্পষ্ট না থাকে ৷” ്