পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট । সমাজ , ዔo¢ উদ্যমের অনেকটা বাজেখরচ হইয়া যায়। এখনো আমাদের সেই হাস্যকর অবস্থােটা কাটিয়া যায় নাই। কিন্তু কাটিয়া যাইবে। পূর্ব-পশ্চিমের আলোড়ন হইতে আমরা কেবলই যে বিষ পাইব, তাহা নহে; যে-লক্ষ্মী ভারতবর্ষের হৃদয়সমুদ্রতলে অদৃশ্য হইয়া আছেন তিনি একদিন অপূৰ্বজ্যোতিতে বিশ্বভুবনের বিস্মিত দৃষ্টির সম্মুখে দৃশ্যমান হইয়া উঠিবেন। নতুবা, যে ভারতে আৰ্যসভ্যতার সর্বপ্রথম উন্মেষ দেখা দিয়াছিল, সেই ভারতেই সুদীর্ঘকাল পরে আর্যসভ্যতার বর্তমান উত্তরাধিকারিগণ কী করিতে আসিয়াছে। জাগাইতে আসিয়াছে। প্রাচীন ভারত তপোবনে বসিয়া একদিন এই জাগরগের মন্ত্র পাঠ করিয়াছিল : -- উত্তিষ্ঠত জাগ্ৰত প্ৰাপ্য বরাননিবোধত । ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া দুর্গং পথপ্তৎকবয়াে বদন্তি । জুলাই কিন্তু শ্ৰেষ্ঠ তাহই প্রাপ্ত হইয়া প্রবুদ্ধ হও। কবিয়া বলিতেছেন, সেই পথ ক্ষুরধারা, দুগম । য়ুরোপও আমাদের রুদ্ধহস্তদায়ের দ্বারে আঘাত করিয়া সেই মন্ত্রের পুনরুচ্চারণ করিতেছে ; বলিতেছে, যাহা শ্রেষ্ঠ, তাহাই প্রাপ্ত হইয়া প্রবুদ্ধ হও । যাহা শ্ৰেষ্ঠ, তাহা আর-কেহ ভিক্ষাস্বরূপ দান । করিতে পারে না ; আবেদনপত্রপুটে তাহা ধারণ করিতে পারে না, তাহা সন্ধান করিতে হইলে দুৰ্গম । পথেই চলিতে হয় । সে পথ কোথায় । অরণ্যে সে-পথ আচ্ছন্ন হইয়া গেছে, তবু পিতামহদের পদচিহ্ন এখনো সে-পথ হইতে লুপ্ত হয় নাই । কিন্তু হয়, পথের চেয়ে সেই পথলোপকারী অরণ্যের প্রতিই আমাদের মমতা । আমাদের মহন্ত্রের মূলধারাটি কোথায় এবং তাঁহাকে নষ্ট করিয়াছে কোন বিকারগুলিতে, ইহা আমরা বিচার করিয়া স্বতন্ত্র করিয়া দেখিতে পারি না। স্বজাতিগর্ব মাঝে মাঝে আমাদের উপর ভর করে, তখন যেগুলি আমাদের স্বজাতির গর্বের বিষয় এবং যাহা লজার বিষয়, যাহা সনাতন এবং যাহা অধুনাতন, যাহা স্বজাতির স্বরূপগত এবং যাহা আকস্মিক, ইহার মধ্যে আমরা কোনো ভেদ দেখিতে পাই না । যাহা আমাদের আছে তাহাকেই ভালো বলিয়া, যাহা আমাদের ছিল তাহাকে অবমানিত করি । এ কথা ভুলিয়া যাই, ভালোর প্রমাণ, সে-ভালোকে যাহারা আশ্রয় করিয়া আছে, তাহারাই। সবই । যদি ভালো হইবে তবে আমরা ভ্ৰষ্ট হইলাম কী করিয়া । ] এ কথা মনে রাখিতে হইবে, যে-আদর্শ যথার্থ মহান তাহা কেবল কালবিশেষ বা অবস্থাবিশেষের । উপযোগী নহে। তাহাতে মনুষ্যকে মনুষ্যত্ব দান করে, সে-মানুষ সকল কালে সকল অবস্থাতেই আপন শ্ৰেষ্ঠতা রাখিতে পারে । . আমার দৃঢ়বিশ্বাস, প্রাচীন ভারতে যে-আদর্শ ছিল তাহা ক্ষণভঙ্গুর নহে ; বিলাতে গেলে তাহা নষ্ট হয় না, বাণিজ্যে প্রবৃত্ত হইলে তাঁহা বিকৃত হয় না, বর্তমান কালোপযোগী কর্মে নিযুক্ত হইতে গেলে তাহা অনাবশ্যক হইয়া উঠে না । যদি তাহা হইত, তবে সে-আদর্শকে মহান বলিতে পারিতাম না । । সকল সভ্যতারই মূল মহত্ত্বসূত্রটি চিরন্তন এবং তাহার বাহ্য আয়তনটি সাময়িক ; তাহা মূলসূত্ৰকে । অবলম্বন করিয়া কালে কালে পরিবর্তিত হইয়া চলিয়াছে । il য়ুরোপীয় সভ্যতার বাহ্য অবয়বটি যদি আমরা অবলম্বন করি, তবে আমরা ভুল করিব। কারণ, যাহা ইংলন্ডের ইতিহাসে বাড়িয়াছে, ভারতের ইতিহাসে তাহার স্থান নাই। এই কারণেই বিলাতে গিয়া আমরা ইংরেজের বাহ্য আচারের যে-অনুকরণ করি, এ দেশে তাহা অস্থানিক অসাময়িক বিদুষ্পমাত্র। কিন্তু সেই সভ্যতার চিরন্তন অংশটি যদি আমরা গ্ৰহণ করি, তবে তাহা সর্বদেশে সৰ্বকালেই কাজে তেমনই ভারতবষীয় প্রাচীন আদর্শের মধ্যেও একটা চিরন্তন এবং একটা সাময়িক অংশ আছে। । V86