পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

° Oや - রবীন্দ্র-রচনাবলী যেটা সাময়িক সেটা অন্য সময়ে শোভা পায় না । সেইটোকেই যদি প্ৰধান করিয়া দেখি, তবে বর্তমান কাল ও বর্তমান অবস্থা দ্বারা আমরা পদে পদে বিড়ম্বিত উপহাসিত হইব। কিন্তু ভারতবর্ষের চিরন্তন আদর্শটিকে যদি আমরা বরণ করিয়া লই, তবে আমরা ভারতবর্ষীয় থাকিয়াও নিজেদের নানা কাল নানা । অবস্থার উপযোগী করিতে পারিব । , এ কথা যিনি বলেন, ভারতবর্ষীয় আদর্শে লোককে কেবলই তপস্বী করে, কেবলই ব্ৰাহ্মণ করিয়া তুলে, তিনি ভুল বলেন এবং গর্বাচ্ছলে মহান আদর্শকে নিন্দা করিয়া থাকেন। ভারতবর্ষ যখন মহান ছিল, তখন সে বিচিত্ররূপে বিচিত্রভাবেই মহান ছিল । তখন সে বীৰ্যে ঐশ্বর্যে জ্ঞানে এবং ধর্মে মহান ছিল, তখন সে কেবলই মালাজপ করিত না । তবে ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতায় আদর্শের বিভিন্নতা কোনখানে। কে কোনটাকে মুখ্য এবং কোনটাকে গৌণ দেখে তাহা লইয়া । ভালোকে সব সভ্যদেশই ভালো বলে। কিন্তু সেই ভালোকে কেমন করিয়া সাজাইতে হইবে, কোনটা আগে বসিবে এবং কোনটা পরে বসিবে সেই রচনার বিভিন্নতা লইয়াই প্ৰভেদ । যেমন সকল জীবের কোষ-উপাদান একই-জাতীয় কিন্তু তাহার সংস্থান নানাবিধ, ইহাও সেইরূপ । কিন্তু এই সংস্থানের নিয়মকে অবজ্ঞা করিবার জো নাই। ইহা আমাদের প্রকৃতির বহুকালীন অভ্যাসের দ্বারা গঠিত। আমরা অন্য কাহারও নকল করিয়া এই মূল উপাদানগুলিকে যেমন খুশি তেমন করিয়া সাজাইতে পারি না ; চেষ্টা করিতে গেলে এমন একটা ব্যাপার হইয়া উঠে, যাহা কোনো কর্মের হয় না । এইজন্য কোনো বিষয়ে সার্থকতা লাভ করিতে হইলে আমাদের ভারতবষীয় প্রকৃতিকে উড়াইয়া দিতে পারিব না। তাহাকে অবলম্বন করিয়া তাহারই আনুকূল্যে আমাদিগকে মহত্ত্ব লাভ করিতে হইবে । 平 |- কেহ বলিতে পারেন, তবে তো কথাটা সহজ হইল। নিজের প্রকৃতিরক্ষার জন্য চেষ্টার দরকার হয় NT (VO ? * হয় । তাহারও সাধনা আছে । স্বাভাবিক হইবার জন্যও অভ্যাস করিতে হয় । কারণ, যে-লোক দুর্বল, তাহাকে নানা দিকে নানা শক্তি বিক্ষিপ্ত করিয়া তোলে। সে নিজেকে ব্যক্ত না করিয়া পাঁচজনেরই অনুকরণ করিতে থাকে। পাঁচজনের আকর্ষণ হইতে আপনাকে উদ্ধার করিতে হইলে নিজের প্রকৃতিকে সবল সক্ষম করিয়া তুলিতে হয় ; সে একদিনের কাজ নহে, বিশেষত বাহিরের শক্তি যখন প্ৰবল । কবি প্ৰথম বয়সে এর ওর নকল করিয়া মরে, অবশেষে প্রতিভার বিকাশে যখন সে নিজের সুরটি ঠিক ধরিতে পারে তখনই সে অমর হয় । তখনই সে-স্বকীয় কাব্যসম্পদে তার নিজেরও লাভ, অন্য সকলেরও লাভ। আমরা যতদিন ইংরেজের নকলে সব কাজ করিতে যাইব, ততদিন এমন কিছু হইবে না। যাহাতে আমাদের সুখ আছে বা ইংরেজের লাভ আছে। যখন নিজের মতো হইব, স্বাভাবিক হইব, তখন ইংরেজের কাছ হইতে যাহা লইব তাহা নুতন করিয়া ইংরেজকে ফিরাইয়া দিতে পারিব । সে দিন নিঃসন্দেহই আসিবে। আসিবে যে তাহার শুভলক্ষণ এই দেখিতেছি, আমাদের পোলিটিক্যাল আন্দোলনের নেশা অনেকটা ছুটিয়া গেছে ; এখন আমরা স্বাধীন চেষ্টায় স্বাধীন সন্ধানে আমাদের ইতিহাসবিজ্ঞানদর্শন আলোচনায় প্রবৃত্ত হইতেছি। আমাদের ধর্ম, আমাদের সমাজের প্রতিও দৃষ্টি পড়িয়াছে। ত্ৰিবেদীমহাশয় বলিয়াছেন, অস্বাভাবিকতাই আমাদের ব্যাধি । অর্থাৎ ইংরেজিশিক্ষাকে আমরা প্রকৃতিগত করিতে পারি নাই, সেই শিক্ষাই আমাদের প্রকৃতিকে আচ্ছন্ন করিতেছে ; সেইজন্যই বিলাতি কিন্তু তিনি আর-একটা কথা বলেন নাই। কেবল ইংরেজ-সভ্যতা নহে, আমাদের দেশীয় সভ্যতা সম্বন্ধেও আমরা অস্বাভাবিক। আমরা তাহার বাহ্যিক ক্ষণিক অংশ লইয়া যে-আড়ম্বর করিতেছি তাহা আমাদের পক্ষে স্বাভাবিক নহে, স্বাভাবিক হইতেই পারে না। কারণ, মনুর সময়ে যাহা সাময়িক