পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(ጳ 8O রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী দেবতারা কেবলই অমৃত পান করিতেছেন, কিন্তু তঁরা বেকার। মাঝে মাঝে দৈত্যরা উৎপাত না করিলে তাদের অমরত্ব তাদের পক্ষে বোঝা হইয়া উঠিত। তঁদের স্বগোেদ্যানে তঁরা ফুল তুলিয়া মালা গাঁথিতে পারেন, কিন্তু সেখানে ফুলগাছের একটা চীনকাও তঁরা বদল করিয়া সাজাইতে পারেন না, কেননা সমস্ত সম্পূর্ণ। মর্তলোকে যেখানে . অপূর্ণতা সেইখানেই নূতনের সৃষ্টি, বিশেষের সৃষ্টি, বিচিত্রের সৃষ্টি। আমাদের রাগরাগিণী সেই স্বর্গোদান। ইহা চিরসম্পূর্ণ। এইজন্যই আমাদের রাগরাগিণীর রসটি সাধারণ বিশ্বরস। মেঘমাল্লার বিশ্বের বর্ষা, বসন্ত বাহার বিশ্বের বসন্ত। মর্তলোকের দুঃখসুখের অন্তহীন বৈচিত্ৰ্যকে সে আমল দেয় না। ’ যে-কোনো তোলেনা লইয়া যদি পরীক্ষা করিয়া দেখি তবে দেখিতে পাইব যে, তার সুরগুলিকে কাটা-কাটা রাখিলে একই রাগিণীর দ্বারা নানাপ্রকার হৃদয়ভাবের বর্ণনা হইতে পারে। কিন্তু সুরগুলিকে যদি গড়ানো করিয়া পরস্পরের গায়ে হেলাইয়া গাওয়া যায় তা হইলে হৃদয়ভাবের বিশেষ বৈচিত্ৰ্য লেপিয়া গিয়া রাগিণীর সাধারণ ভাবটা প্রকাশ হইয়া পড়ে। এটা কেমনতরো ? যেমন দেখা গেছে। খুড়তত জাঠতত মাসতত পিসতত প্রভৃতি অসংখ্যা সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম পারিবারিক শ্রীতির বঁাধনে যে ছেলেটি অত্যন্ত ঠাসা হইয়া একেবারে ঠাণ্ড হইয়া থাকে, সেই ছেলেই বৃহৎ পরিবার হইতে বাহির হইয়া, জাহাজের খালাসিগিরি করিয়া নিঃসম্বলে আমেরিকায় গিয়া, আজ খুবই শক্ত সমর্থ সজীব সতেজ ভাবে ধড়ফড় করিয়া বেড়াইতেছে ; আগে সে পরিবারের ঠেলাগাড়িতে পূর্বপুরুষের রাস্তায় বঁধিবরাদ্দমতো হাওয়া খাইত। এখন সে নিজে ঘোড়া হাঁকাইয়া চলে এবং তার রাস্তার সংখ্যা নাই। বাঁধনছাড়া সুরগুলো যে গানকে গড়িয়া তোলে তার খেয়াল নাই সে কোন শ্রেণীর, সে এই জানে যে স্বনামী পুরুষো ধন্যঃ” । । শুধুমাত্র রসকে ভোগ করা নয়। কিন্তু আপনাকে প্রকাশ করা যখন মানুষের অভিপ্ৰায় হয়, তখন সে এই বিশেষত্বের বৈচিত্র্যকে ব্যক্ত করিবার জন্য ব্যাকুল হইয়া ওঠে। তখন সে নিজের আশা আকাঙ্ক্ষা হাসি কান্না সমস্তকে বিচিত্র রূপ দিয়া আর্টের অমৃতলোক আপন হাতে সৃষ্টি করিতে থাকে। আত্মপ্রকাশের এই সৃষ্টিই স্বাধীনতা। ঈশ্বরের রচিত এই সংসার অসম্পূর্ণ বলিয়া একদল লোক নালিশ করে। কিন্তু যদি অসম্পূৰ্ণ না হইত। তবে আমাদের অধীনতা চিরন্তন হইত। তা হইলে যা-কিছু আছে তাঁহাই আমাদের উপর প্রভুত্ব করিত, আমরা তার উপর একটুও হােত চালাইতে পারিতাম না। অস্তিত্বটা গলার শিকল পায়ের বেড়ি হইত। শাসনতন্ত্র যতই উৎকৃষ্ট হােক, তার মধ্যে শাসিতের আত্মপ্রকাশের কোনো যােকই যদি কোথাও না থাকে, তবে তাহা সোনার দড়িতে চিরউদ্দবন্ধন। মহাদেব নারদ এবং ভরতমুনিতে মিলিয়া পরামর্শ করিয়া যদি আমাদের সংগীতকে এমন চূড়ান্ত উৎকর্ষ দিয়া থাকেন যে আমরা তাকে কেবলমাত্র মানিতেই পারি, সৃষ্টি করিতে না পারি, তবে এই সুসম্পূর্ণতার দ্বারাই সংগীতের প্রধান উদ্দেশ্য নষ্ট হইয়াছে চৈতন্যের আবির্ভাবে বাংলাদেশে বৈষ্ণবধর্ম যে হিল্লোল তুলিয়াছিল। সে একটা শাস্ত্রছাড়া ব্যাপার। তাহাতে মানুষের মুক্তি-পাওয়া চিত্ত ভক্তিরসের আবেগে আত্মপ্রকাশ করিতে ব্যাকুল হইল। সেই অবস্থায় মানুষ কেবল স্থাবরভাবে ভোগ করে না, সচলভাবে সৃষ্টি করে। এইজনা সেদিন কাব্যে ও সংগীতে বাঙালি আত্মপ্রকাশ করিতে বসিল। তখন পয়ার ত্রিপদীর বাঁধা ছান্দ প্রচলিত বাধা কাহিনী পুনঃপুনঃ আবৃত্তি করা আর চলিল না। বাঁধন ভাঙিল- সেই বাঁধন [ভািঙ] বস্তুত প্ৰলয় নহে, তাহা সৃষ্টির উদ্যম। আকাশে নীহারিকার যে ব্যাপকতা তার একটা অপর’ মহিমা আছে। কিন্তু সৃষ্টির অভিব্যক্তি এই ব্যাপকতায় নহে। প্রত্যেক তারা আপনাতে আপনি