পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ó ዒbr " রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী মাথায় অবিশ্রাম ঝরঝর বৃষ্টি পড়ছে। আর কলকাতায় বৃষ্টি পড়ছে আহিরিটােলায়, কিন্তু আজকাল ব্যাঙ ডাকে না কেন ? আমি কলকাতার কথা বলছি। ছেলেবেলায় মেঘের ঘটা হলেই ব্যাঙের ডাক শুনতুম- কিন্তু আজকাল পাশ্চাত্য সভ্যতা এল, সার্বভৌমিকতা এবং “উনবিংশ শতাব্দী এল, পোলিটিকাল অ্যাজিটেশন, খোলা ভাটি এবং স্বায়ত্তশাসন এল, কিন্তু ব্যাঙ গেল কোথায় ? হায় হয়, কোথায় ব্যাস বশিষ্ঠ, কোথায় গৌতম শাক্যসিংহ, কোথায় ব্যাঙের ডাক! ছেলেবেলায় যেমন বর্ষা দেখতেম, তেমন ঘনিয়ে বর্ষাও এখন হয় না। বর্ষার তেমন সমারোহ নেই যেন, বর্ষ এখন যেন ইকনমিতে মন দিয়েছে- নমো নমো করে জল ছিটিয়ে চলে যায়- কেবল খানিকটা কাদা, খানিকটা হাঁট, খানিকটা অসুবিধে মাত্র- একখানা ছেড়া ছাতা ও চীনে বাজারের জুতোয় বর্ষা কাটানো যায়- কিন্তু আগেকার মতো সে বস্ত্ৰ বিদ্যুৎ বৃষ্টি বাতাসের মাতামতি দেখি নে। আগেকার বর্ষায় একটা নৃত্য ও গান ছিল, একটা ছন্দ ও তাল ছিল- এখন যেন প্রকৃতির বর্ষার মধ্যেও বয়স প্রবেশ করেছে, হিসাব কিতাব ও ভাবনা ঢুকেছে, শ্লেষ্মা শঙ্কা ও সাবধানের প্রাদুর্ভাব হয়েছে। লোকে বলছে, সে আমারই বয়সের দোষ। তা হবে! সকল বয়সেরই একটা কাল আছে, আমার সে বয়স গেছে হয়তো। যৌবনের যেমন বসন্ত, বার্থক্যের যেমন শরৎ, বাল্যকালের তেমনি বর্ষা। ছেলেবেলায় আমরা যেমন গৃহ ভালোবাসি এমন আর কোনো কালেই নয়। বর্ষাকাল ঘরে থাকবার কাল, কল্পনা করবার কাল, গল্প শোনবার কাল, ভাইবোনে মিলে খেলা করবার কাল। বর্ষার অন্ধকারের মধ্যে অসম্ভব উপকথাগুলো কেমন যেন সত্যি হয়ে দাঁড়ায়। ঘনবৃষ্টিধারার আবরণে পৃথিবীর আপিসের কাজগুলো সমস্ত ঢাকা পড়ে যায়। রাস্তায় পথিক কম, ভিড় কম, হাটে ঘাটে কাজের লোকের ঘোরতর ব্যস্ত ভাব আর দেখা যায় না- ঘরে ঘরে দ্বারারুদ্ধ, দোকানপসারের উপর আচ্ছাদন পড়েছে- উদরানালের ইস্টিম প্রভাবে মনুষ্যসমাজ যে রকম হাঁসৰ্ব্বাস ক'রে কাজ করে সেই হাঁসফাসানি বর্ষাকালে চোখে পড়ে না। এইজন্যে মনুষ্যসমাজের সাংসারিক আবর্তের বাইরে বসে উপকথাগুলিকে সহজেই সত্য মনে করা যায়, কেউ তার ব্যাঘাত করে না। বিশেষত মেঘ বৃষ্টি বিদ্যুতের মধ্যে উপকথার উপকরণ আছে যেন। যেমন মেঘ ও বৃষ্টিধারা আবরণের কাজ করেতেমনি বৃষ্টির ক্রমিক একঘেয়ে শব্দও একপ্রকার আবরণ। আমরা আপনার মনে যখন থাকি তখন অনেক কথা বিশ্বাস করি।- তখন আমরা নির্বোধি, আমরা পাগল, আমরা শিশু; সংসারের সংস্রবে: আসলেই তবে আমরা সম্ভব-অসম্ভব বিচার করি, আমাদের বুদ্ধি জেগে ওঠে, আমাদের বয়স ফিরে পাই। আমরা অবসর পেলেই আপনার সঙ্গে পাগলামি করি, আপনাকে নিয়ে খেলা করি।- তাতে আমাদের কেউ পাগল বলে না, শিশু বলে না- সংসারের সঙ্গে পাগলামি বা খেলা করলেই আমাদের নাম খারাপ হয়ে যায়। একটু ভেবে দেখলেই দেখা যায় বুদ্ধি বিচার তর্ক বা চিন্তার শৃঙ্খলা- এ আমাদের সহজ ভাব নয়, এ আমাদের যেন সংসারে বেরোবার আপিসের কাপড়দ্বিতীয় ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করবার সময়েই তার আবশ্যক- আপনার ঘরে এলেই ছেড়ে ফেলি। আমরা স্বভাব-শিশু, স্বভাব-পাগল, বুদ্ধিমান সেজে সংসারে বিচরণ করি। আমরা আপনার মনে বসে যা ভাবি- অলক্ষ্যে আমাদের মনের উপর অহরহ যে-সকল চিন্তা ভিড় করে- সেগুলো যদি কোনো উপায়ে প্রকাশ পেত। সংসারের একটু সাড়া পেয়েছি কী, একটু পায়ের শব্দ শুনেছি কী আমনি চকিতের মধ্যে বেশ পরিবর্তন করে নিই- এত দ্রুত যে আমরা নিজেও এ পরিবর্তনপ্রণালী দেখতে পাই নে। তাই বলছিলেম যদি কোনোমতে আমরা আপনার মনে থাকতে পাই তা হলে আমরা অনেক অসম্ভবকে বিশ্বাস করতে পারি। সেইজন্যে গভীর অন্ধকার রাত্রে যা সন্তৰ দিলে বোধহয় দিনের আলোতে তার অনেকগুলি কোনোমতে সম্ভব বােধহয় না— কিন্তু