পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্ৰন্থসমালোচনা ዪኃoዔ চুরির প্রাদুর্ভাব হইয়াছে। সমালোচ্য গ্ৰন্থখানির বিজ্ঞাপনে দেখিতেছি, যোগেন্দ্রবাবুর আর্ষিদর্শনে প্রকাশিত অনেকগুলি প্ৰবন্ধ এইরূপ চুরি যায়; চোরের হত হইতে রক্ষা করিবার জন্য আৰ্যদর্শনসম্পাদক তাহার ভারত-বিষয়ক প্ৰবন্ধগুলি পুস্তকাকারে মুদ্রিত করিয়াছেন। অনেকগুলি প্রবন্ধে লেখকের চিন্তাশীলতার যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু যথার্থ কথা বলিতে কি, প্রাচীন ভারতের উন্নতি লইয়া গর্ব, আধুনিক ভারতের অবনতি লইয়া দুঃখ, ঐক্যের অভাব লইয়া বিলাপ, বদ্ধপরিকর হইবার জন্য উত্তেজনা এত শুনা গিয়াছে যে, ও বিষয়ে শুনিবার আর বাসনা নাই। শুনিয়া যত দূর হইতে পারে তাহা এত দিনে হইয়াছে বোধ করি, বরঞ্চ ভাবগতিকে বোধ হয় মাত্রা অধিক হইয়া গিয়াছে। না। যদি হইয়া থাকে তো আশ্চর্যাবলিতে হইবে। ভারতের বিষয়ে কতকগুলো বিলাপ ও উদ্দীপন বাক্য উচ্চারণ করিবার কাল চলিয়া গিয়াছে। যখন ভাব মাত্র লোকে জানিত না, তখন তাহা উপযোগী ছিল। ভারতের যে পূর্বে উন্নতি ছিল ও এখন যে অবনতি হইয়াছে, ভারতের উন্নতি সাধন করিতে সকলের যে সম্মিলিত হওয়া উচিত এ বিষয়ে বঙ্গীয় পাঠকমাত্রেই এতিবার শুনিয়াছেন, যে, এ বিষয় বোধ করি। কাহারো জ্ঞানের অগোচর নাই। অতএব আর অধিক নহে। এখন “ঐক্য” “উন্নতি” “বন্ধন” প্রভৃতি কতকগুলা সাধারণ কথা পরিত্যাগ করিয়া, ঐক্য ও উন্নতি সাধনের যে শত সহস্ৰ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাধা আমাদের সহিত এক পরিবারভুক্ত হইয়া বাস করিতেছে সেই সকল বিশেষ বিশেষ বিষয়ের আলোচনা করিবার সময় উপস্থিত হইয়াছে। বড়ো বড়ো কথা শুনিয়া আমাদের যুবকদিগের একটা বিষম রোগ উপস্থিত হইয়াছে। তাহারা তঁহাদের দুই দুর্বল হস্তে দুই গুরুভার তরবারি লইয়া অধীনতা ছেদন করিবার জন্য দিগবিদিক হাতড়াইয়া দাপাদাপি করিয়া বেড়াইতেছেন। তঁহাদের যদি বলা যায়, অত হাঙ্গাম করিবার আবশ্যক কী? অধীনতার অন্বেষণে দুচাবাজির মতো চারি দিকে ধড়ফড় করিয়া বেড়াইতেছে কেন? অধীনতা যে তোমাদের দুয়ারের কাছে। এমন-কি, তোমাদের গৃহের কোণ হইতে শত শত অধীনতার পাশ অতি সূক্ষ্ম মাকড়সার জলের মতো তোমাদের হাত-পা বেষ্টন করিয়া ধরিয়াছে। তলোয়ার দুটা রাখে। একে একে ধীরে ধীরে সেই সূক্ষ্ম গ্ৰন্থিগুলা মোচন করো। এ কথা শুনিলে তঁাহারা নিতান্ত নিরুৎসাহ হইয়া পড়েন। তাহারা ওই সরু সূতাগুলি দেখাইয়া দিলে তাহারা অপমান বোধ করেন। কেবল বড়ো বড়ো ভারী ভারী কথা শুনিয়া আমাদের এই দশা হইয়াছে। এখন ছোটো ছোটো ঘরের কথা কহিবার সময় আসিয়াছে। এখন এই মহাবীরবৃন্দকে ঠাণ্ডা করিয়া তাঁহাদের মুখের কথাগুলাকে হাঁটিয়া, তাহদের বনে মহিষ তাড়াইতে যাইবার পূর্বে ঘরে ইদুরের উৎপাত দূর করা হউক। তাই বলিতেছি। হৃদয়োচ্ছাসের অনেকগুলি প্রবন্ধে লেখকের দেশানুরাগ প্রকাশিত হইয়াছে, কিন্তু বর্তমান আমরা এমন কথা বলিতে পারি না। ইহাতে অনেকগুলি প্ৰবন্ধ আছে যাহা সময়োপযোগী, বিশেষ-বিষয়গত ও সমাজের হিতসাধক। স্যামুয়েল হানিমানের জীবনবৃত্ত। শ্ৰীমহেন্দ্রনাথ রায় কর্তৃক বিরচিত। মূল্য ছয় আনা। যোগেন্দ্রবাবুর অনুসরণ করিয়া ইতিমধ্যেই আর-এক জন লেখক বঙ্গভাষায় আর-এক মহাত্মার জীবনবৃত্ত, রচনা করিয়াছেন, দেখিয়া আনন্দিত হইলাম। ইহা পুস্তক বিশেষের অনুবাদ নহে; লেখক অনেক পরিশ্রম ও অন্বেষণ করিয়া গ্ৰন্থখানি সংকলন করিয়াছেন। আমাদের দেশে এরাপ অধ্যবসায় প্রশংসাযোগ্য। গ্রন্থের ভাষা তেমন সহজ, পরিষ্কার সরস হয় নাই। অনর্থক কতকগুলো কঠোর সংস্কৃত কথা ও ঘোরালো পদ ব্যবহার করা হইয়াছে, এইজন্য পুস্তকখানি সুপাঠ্য হয় নাই। গ্রন্থকার হানিমানের জীবনী হইতে পদে পদে রাশি রাশি নীতি কথা বাহির করিয়াছেন,