পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৬২২ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী টীকা ও অনুবাদের সাহায্যে জগতের এই প্রাচীনতম তত্ত্বজ্ঞানভাণ্ডারে প্রবেশলাভ করিয়া আমরা চরিতার্থ হইয়াছি। প্রবেশ লাভ করিয়াছি এ কথা বলা ঠিক হয় না। কারণ, এই প্রাচীন উপনিষৎগুলিতে ব্ৰহ্মতত্ত্ব আদ্যোপাড় সংশ্লিষ্টভাবে প্রকাশিত হয় নাই। পাঠ করিতে করিতে মনে হয়, শ্লোকগুলি যেন কঠিন তপস্যার সংঘর্ষজনিত এক-একটি তেজ-স্ফুলিঙ্গের মতো ঋষিদের হৃদয় হইতে বৰ্ষিত হইতেছে- যে স্মৃলিঙ্গের সংস্পর্শে পরবর্তীকালে ভারতীয় দর্শন ষড়শিখা হুতাশনের ন্যায় জুলিয়া উঠিয়াছিল। এই সকল উপনিষৎ-কথিত শ্লোকগুলি সর্বত্র সুগম নহে এবং বহুকালের পরবতী কোনো ভাষ্যকার, ঋষিদের গুঢ় অভিপ্রায় যে সর্বত্র ভেদ করিতে সক্ষম হইয়াছেন অথবা সক্ষম হইতে পারেন। এরূপ আমাদের বিশ্বাস নহে; কারণ, অনেক স্থলেই শ্লোকগুলি পড়িলে, আর কিছুই ভালো বুঝা যায় না, কেবল এইটুকু বুঝা যায়, যে, সেগুলি নিগুঢ় এবং সংক্ষিপ্ত সংকেত মাত্র। সেই সংকেতের প্রকৃত অর্থ তপোবনবাসী সাধক এবং তাহার শিষ্যদের মধ্যেই প্রচলিত ছিল, এবং সেই ভাবাৰ্থ ক্রমশ শিয্যানুশিষ্যপরম্পরাক্রমে এবং কালভেদে মতের বিচিত্র পরিণতি অনুসারে বহুল পরিমাণে পরিবর্তিত হইবার কথা। তাহারা যে শব্দ যে বিশেষ অর্থে ব্যবহার করিতেন এখন আমরা আমাদের বর্তমান জ্ঞানের অবস্থা অনুসারে সম্ভবত তাহার অন্যরূপ ব্যাখ্যা করিয়া থাকি। এইজন্য সর্বত্র আমরা ভাবের সামঞ্জস্য সাধন করিতে পারি না। অথচ অনেকগুলি উজ্জ্বল সত্যের আভাস আমাদের হৃদয়ে জাগ্রত হইয়া উঠে। কিন্তু সেইগুলিকে যখন আপন মনে স্পষ্ঠীকৃত করিতে চেষ্টা করি তখনই সংশয় হয়, ইহার কতখানি বাস্তবিক সেই ঋষির কল্পিত এবং কতখানি আমার কল্পনা। একটি উদাহরণ দিলে পাঠকগণ আমার কথা বুঝিতে পরিবেন। অথর্ববেদের প্রশ্নোপনিষদে আছে- প্ৰজাপতি প্ৰজাকাম হইয়া তপস্যা করিলেন এবং তপস্যা করিয়া রয়ি (অর্থাৎ আদিভূত) এবং প্রাণ (অর্থাৎ চৈতন্য) এই মিথুন উৎপাদন করিলেন। আদিত্যই প্ৰাণ, চন্দ্ৰমাই রয়ি; মূর্ত ও অমূর্ত (সংশ্লিষ্ট) যাহা-কিছু এই সমস্তই রয়ি; (তন্মধ্যগত) মূর্ত বস্তু তো রয়ি বটেই। - বন্ধনী চিহ্নবতী শব্দগুলি মূলের নহে। অতএব, পিপ্পলাদ ঋষি রয়ি এবং প্রাণ শব্দ ঠিক কী অর্থে ব্যবহার করিতেন তাহা বলা কঠিন। ভাষ্যকার-কৃত অর্থের অনুবতী হইয়াও যে, সর্বত্র সমস্তই সুস্পষ্ট হইয়া উঠে তাহাও বলিতে পারি না; কারণ, আদিত্যকেই বা কেন চৈতন্য এবং চন্দ্ৰমাকেই বা কেন আদিভূত বলা হইল তাহার কোনো তাৎপর্য দেখা যায় না। অথচ আভাসের মতো এই তত্ত্ব মনে উদয় হয়, যে- দুই বিরোধী শক্তির মিলনে এই সৃষ্টিপ্রবাহ চলিয়া আসিতেছে, ভালো ও মন্দ, চেতনা ও জড়তা, জীবন ও মৃত্যু, আলোক ও অন্ধকার- রয়ি এবং প্ৰাণশব্দে স্পষ্ট ভাবে হীেক অস্পষ্টভাবে হীেক এই মিথুন নির্দিষ্ট হইয়াছে। এই প্রশ্নোপনিষদের স্থানান্তরে রহিয়াছে শুক্লপক্ষ প্ৰাণ এবং কৃষ্ণপক্ষ রয়ি; দিন প্ৰাণ এবং রাত্রি রয়ি।। কৰ্ণ দ্বারা আমরা রায়িকে প্রাপ্ত হই, ব্ৰহ্মচৰ্য, শ্রদ্ধা ও জ্ঞান দ্বারা আমরা প্ৰাণকে প্রাপ্ত হই। যাহাই হীেক, এই শ্লোকগুলি হইতে আমাদের মনে যে তত্ত্বটি প্রতিভাত হইতেছে তাহা এই উপনিষদের অভিপ্ৰেত কি না। আমরা নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারি না- আর কাহারও মনে অন্য কোনোরূপ অর্থেরও উদয় হইতে পারে। অর্থ স্পষ্ট হীেক বা না হীেক এই উপনিষৎগুলির মধ্যে যে একটি সরল উদারতা, গভীরতা, প্রশান্তি এবং আনন্দ আছে তাহা বাংলা অনুবাদেও প্রকাশ পাইতেছে।ইহার সর্বত্রই অনির্বচনীয়কে বচনে প্রকাশ করিবার যে অসীম ব্যাকুলতা বিদ্যমান আছে তাহা এত সুগভীর যে, তাহাতে চাঞ্চল্য নাই। ইহাতে ঋষিরা জ্ঞানের এবং বাক্যের পরপারে ব্ৰহ্মাকে যতদূর পর্যন্ত অনুসরণ চুরিয়াছেন এমন আর কোনো ধর্মে করে নাই, অথচ তাহাকে যত নিকটতম অন্তরতম আত্মীয়তম