পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাময়িক সাহিত্য সমালােচনা vectà জ্বলিয়া ভস্ম হইতে বসিয়াছি। পিতামাতার মেহের বন্ধন যাহার ছিন্ন, সে যে ভালোবাসার কত কঙাল, তাহা, তুমি, ঐশ্বর্ষের দাসানুদাস, কী বুঝিবে? আমি ভালোবাসার কাঙাল, কিন্তু ভালোবাসাকেও তুচ্ছ করিয়া ঠেলিয়া ফেলিয়াছি, দেবত্বের আকর্ষণে” সম্পাদক মহাশয়কে আমরা কেহই বুঝিতে পারি নাই- কারণ আমরা ঐশ্বর্ষের দাসানুদাস এবং তাঁহার মহীয়ান মস্তকে দারিদ্র্যের মুকুট; কিন্তু এমনি করিয়া যদি মধ্যে মধ্যে উচ্চৈঃস্বরে নিজেই বুঝাইতে শুরু করেন তাহা হইলে না বুঝিয়া আমাদের উপায় থাকিবে না। “দেবত্বের আকর্ষণে” তিনি আমাদিগকে ছাড়াইয়া যে কতদূর পর্যন্ত পৌঁছিয়াছেন তাহা লিখিয়াছেন- আদর্শ ভুলিয়া আমি জটিল, কুটিল, মলিন, অপবিত্র ভালোবাসা বা একতা চাহি না। যদি তাঁহারই কাঙাল হইতাম, যাহাদের সহিত রক্তের সংস্রব ছিল তাঁহাদের স্নেহ ভূলতাম না। তঁহাদের স্নেহডোর ছিন্ন করিয়া দূরে দূরে, বিদেশে বিদেশে, নির্জনে নির্জনে, একাকিত্বের রাজ্যে কঙালের ন্যায় বেড়াইতাম না! কিন্তু এ কথা কেহ মনে করিয়ো না, নব্যভারতের সম্পাদক হওয়ার পর হইতে অদ্য পঞ্চদশ বৎসর ইহাঁর এই দশা! বাল্যকালে সুলক্ষণগুলি ছিল লেখক সে আভাস দিতে ছাড়েন নাই। আদর্শহীনতার জন্য বাল্যকাল হইতে কতজনের স্নেহডোর ছিাড়িয়াছি; যত লোকের নিকট গিয়াছি, যখনই তাঁহাদের মধ্যে আদর্শহীনতা দেখিয়াছি, তখনই ছুটিয়া পলাইয়াছি। সেজন্য তাহারা আমার প্রতি আজি কত বিরক্ত! সেজন্য র্তাহারা কত ক্ৰোধান্বিত!’ আমাদের সহিত কত প্ৰভেদ! আমরা যখন ইস্কুল পলাইতাম, আমাদের সম্পাদক মহাশয় সেই বয়সে আদর্শহীনতা’ হইতে পলায়ন করিতেন। মাস্টার আমাদের প্রতি রাগ করতেন। কিন্তু তাহার প্রতি ক্রোধান্বিত হইত জগতের সমস্ত আদর্শহীন ব্যক্তিরা! ভাবিয়া দেখো, সেই বালকটি বড়ো হইয়াছে এবং আজ লিখিতেছে চাহিয়াছি সত্য, পাইয়াছি মিথ্যা; চাহিয়াছি পুণ্য, পাইয়াছি পাপ; চাহিয়াছি স্বৰ্গ, পাইয়াছি নরক, চাহিয়াছি আন্তরিকতা, পাইয়াছি বাহ্যাড়ম্বর; চাহিয়াছি দেবত্ব, পাইয়াছি পশুত্ব; চাহিয়াছি সাত্ত্বিকতা, পাইয়াছি রাজসিকতা; চাহিয়াছি অমরত্ব, পাইয়াছি নশ্বরত্ব। কী তীব্র অভিজ্ঞতা!’ মহাপুরুষকে মিনতি করি তিনি শান্ত হউন, ক্ষান্ত হউন, ভাষাকে সংযত করুন, পৃথিবীকে ক্ষমা করুন, পাঠকদিগের প্রতি দয়া করুন, তাহার নববর্ষ নাট্যশালার কৃত্ৰিম বজ্রটিকে প্রতিসংহার করিয়া লউন! তিনি যে সত্য চাহিয়াছিলেন সে গীেরবর্তহারই থাক এবং যে মিথ্যা পাইয়াছেন সে লাঞ্ছনা। আর সকলে বহন করিবে; তিনি যে পুণ্য চাহিয়া ফিরিয়াছিলেন সে দুর্বিষহ সাধুতা তাঁহাতেই বর্তিবে, এবং যে পাপ পাইয়াছেন সে অক্ষয় কলঙ্ক অপর সাধারণের ললাট আঁকিয়া দিন; তিনি স্বগীয় তাই স্বৰ্গ চাহিয়াছিলেন। কিন্তু নরক পাইয়াছেন সে হয়তো তাহারই আত্মদোষে নহে; তিনি অকপট, তাই চাহিয়াছিলেন আন্তরিকতা কিন্তু বাহ্যাড়ম্বরটা- সে আর কী বলিব! পরন্তু বর্তমান প্রবন্ধে তিনি যেরূপ আদর্শ হইয়া উঠিয়াছেন, পায়ে ধরিয়া প্রার্থনা শুক্রগুলি তেমন্ট হতে পারবে না, কারণ, “ঘূণালজ্জা’ একেবারেই পরিত্যাগ করা বড়ো এই প্রসঙ্গে সম্পাদকের নিকট আমাদের একটি মিনতি আছে। যদিও তাঁহার হৃদয়োচ্ছাস সাধারণের অপেক্ষা অনেক বেশি তথাপি বিস্ময়সূচক বা প্রবলতাসূচক তিলকচিহ্নগুলি () স্থানে স্থানে দ্বিগুণীকৃত করিয়া কোনো লাভ নাই। উহাকে লেখার মুদ্রাদোষ বলা যাইতে পারে। এ প্রকার চিহ্নকে একাধিক করিয়া তুলিলে কোথাও তাহার সীমা স্থাপন করা যায় না। ভাবিয়া দেখুন কোনো একটি নব্যতর-ভারত সম্পাদকের হৃদয়োচ্ছাস যদি দুৰ্দৈবক্রমে দ্বিগুণতর হয় তবে তিনি কী তীব্র অভিজ্ঞতা' লিখিয়া তাহার পশ্চাতে চারটি!!!! তিলক চিহ্ন বসাইতে পারেন- এবং এইরূপ রোখি চড়িয়া গেলে ক্ৰমে ভাষার অপেক্ষা ইঙ্গিতের উপদ্রব বাড়িয়া, চলিবে। এ কথা মুকুলাবার মুহালৰ যোগ করিয়া দেন, তবে তাহা সাধারণ লোকের পক্ষে কিছু অধিক পড়ে।